সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

কেন এত দুঃখকষ্ট ও অবিচার?

কেন এত দুঃখকষ্ট ও অবিচার?

অধ্যায় ৬

কেন এত দুঃখকষ্ট ও অবিচার?

যাইহোক, যদি পরমেশ্বরের উদ্দেশ্য ছিল পরমদেশীয় পরিস্থিতির মধ্যে পৃথিবীতে সিদ্ধ মানব চিরকাল বাস করুক আর সেটি যদি এখনও তাঁর উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কেন এখন পরমদেশ নেই? পরিবর্তে, বহু শতাব্দী ধরে মানুষ কেন দুঃখকষ্ট ও অবিচার ভোগ করছে?

কোন সন্দেহ নেই, যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী বিজয়লাভ, শোষণ, অবিচার, দারিদ্র্য, বিপর্যয়, অসুস্থতা এবং মৃত্যুর মত দুঃখ-দুর্দশা দ্বারা মানব ইতিহাস পূর্ণ। বহু নির্দোষ ব্যক্তিদের প্রতি কেন এত মন্দ বিষয়গুলি ঘটে থাকে? যদি ঈশ্বর সর্ব-শক্তিমান হন, তাহলে কেন তিনি হাজার হাজার বছর ধরে প্রচণ্ড দুঃখকষ্ট থাকতে অনুমতি দিয়েছেন? যেহেতু ঈশ্বর এত সুন্দরভাবে মহাবিশ্বকে পরিকল্পনা এবং সুসঙ্গত করেছেন তাই, কেন তিনি পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলতা ও ধ্বংসের অনুমতি দেবেন?

একটি উদাহরণ

আসুন, আমরা একটি উদাহরণের দ্বারা ব্যাখ্যা করি যে কেন এক শৃঙ্খলার ঈশ্বর বিশৃঙ্খলার অনুমতি দেবেন। যদি পারেন, কল্পনা করুন যে আপনি এক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এবং একটি বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছেন। বাড়িটি ভাল করে দেখে, আপনি দেখলেন যে বাড়িটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। তার জানালা ভাঙ্গা, ছাদে ফাটল ধরেছে, কাঠের বারান্দায় ঘুন ধরেছে, দরজাটি একটি কব্জায় ঝুলে রয়েছে আর জলের কলগুলি কাজ করছে না।

এই সকল ত্রুটিগুলি দেখে, আপনি কি এই পরিসমাপ্তিতে আসবেন যে কোন বুদ্ধিমান পরিকল্পক সেই বাড়িটির পরিকল্পনা করতে পারে না? সেই বিশৃঙ্খলতা কি আপনাকে এটি বিশ্বাস করতে নিশ্চিত করবে যে একমাত্র অপ্রত্যাশিত ঘটনাই হয়ত সেই বাড়িটি তৈরি করেছে? অথবা, আপনি যদি মনে করে থাকেন যে কেউ সেটিকে পরিকল্পনা এবং নির্মাণ করেছে, তাহলে আপনি কি ভাববেন যে সেই ব্যক্তি দক্ষ বা চিন্তাশীল ছিল না?

কিন্তু যখন আপনি কাঠামোটিকে আরও বিশদভাবে পরীক্ষা করলেন তখন দেখলেন যে তা প্রথমে খুব ভালভাবেই গঠন করা হয়েছিল এবং তা বেশ চিন্তাশীল মনের পরিচয় দেয়। কিন্তু এখন সেটি ভেঙ্গে পড়েছে এবং ধ্বংস হতে চলেছে। এই ত্রুটিগুলি ও সমস্যা কী ইঙ্গিত দেয়? এগুলি হয়ত এই ইঙ্গিত দিতে পারে যে (১) মালিক মারা গেছেন; (২) তিনি এক দক্ষ নির্মাতা কিন্তু এখন আর বাড়ির প্রতি আগ্রহী নন; অথবা (৩) তিনি উপলব্ধি দেখাতে অক্ষম এমন ভাড়াটের কাছে কিছুকালের জন্য তার সম্পত্তি লীজে দিয়েছেন। পৃথিবীর পরিস্থিতি সর্বশেষের পরিস্থিতিটির অনুরূপ।

কিসের ভুল হয়

বাইবেলের আদি বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি যে মানুষ দুঃখকষ্ট ভোগ করুক বা মারা যাক, ঈশ্বরের উদ্দেশ্য এরূপ ছিল না। আমাদের প্রথম পিতামাতা, আদম ও হবা, মারা যায় একমাত্র ঈশ্বরের অবাধ্য হয়েছিল বলেই। (আদিপুস্তক, অধ্যায় ২ এবং) অবাধ্য হওয়ার পর, তারা আর ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করে না। ঈশ্বরের যত্ন থেকে তারা সরে গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, তারা নিজেদের “জীবনের উনুই” ঈশ্বরের সংযোগ থেকে ছিন্ন করেছিল।—গীতসংহিতা ৩৬:৯.

যেমন একটি যন্ত্র, শক্তির উৎস থেকে সংযোগ ছিন্ন হলে ধীরে ধীরে থেমে যায়, ঠিক সেইরূপ তাদের দেহ ও মন অধঃপতিত হয়। ফলে, আদম ও হবার অবনতি ঘটে, বৃদ্ধ হয় এবং অবশেষে মারা যায়। তারপর কী হয়? তারা যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফিরে যায়: “তুমি ধূলি, এবং ধূলিতে প্রতিগমন করিবে।” ঈশ্বর তাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন যে তাঁর নিয়মের অবাধ্য হলে তার প্রতিফল হবে মৃত্যু: তুমি “মরিবেই মরিবে।”—আদিপুস্তক ২:১৭; ৩:১৯.

শুধুমাত্র আমাদের প্রথম পিতামাতা মারা গিয়েছিল তা নয়, কিন্তু তাদের সকল বংশধরেরা, সমস্ত মানবজাতিও মৃত্যুর কবলিত হয়েছে। কেন? কারণ প্রজননবিদ্যার নিয়মানুসারে পিতামাতার বৈশিষ্ট্য সন্তানেরা উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। আমাদের প্রথম পিতামাতার কাছ থেকে তাদের সন্তানেরা উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছিল তা হল অসিদ্ধতা ও মৃত্যু। রোমীয় ৫:১২ পদ আমাদের বলে: “এক মনুষ্য [আদম, মানবজাতির প্রথমপিতা] দ্বারা পাপ, ও পাপ দ্বারা মৃত্যু জগতে প্রবেশ করিল; আর এই প্রকারে মৃত্যু সমুদয় মনুষ্যের কাছে উপস্থিত হইল, কেননা সকলেই পাপ করিল [অসিদ্ধতা অর্থাৎ পাপমূলক প্রবণতা, উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে]।” আর যেহেতু সেই তখন থেকেই পাপ, অসিদ্ধতা এবং মৃত্যু সম্বন্ধেই একমাত্র লোকে জানে এবং অনেকে সেগুলিকে স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করে। তবুও, প্রথম মানুষকে চিরকাল বেঁচে থাকার ক্ষমতা ও ইচ্ছা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল। তাই বেশির ভাগ লোকে মৃত্যুতেই তাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে ভেবে হতাশা বোধ করে।

এতদিন পর্যন্ত কেন?

কেন ঈশ্বর এতদিন ধরে মানুষকে স্বাধীনভাবে নিজেদের পথে চলতে অনুমতি দেন? এই এতগুলি শতাব্দী ধরে কেন তিনি দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন? একটি মুখ্য কারণ হল যে এক গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য বিষয় উত্থাপিত করা হয়েছিল: শাসন করার অধিকার কার আছে? মানুষের শাসক কি ঈশ্বর হবেন, অথবা তারা ঈশ্বর ব্যতীত নিজেরাই নিজেদের সফলভাবে শাসন করতে পারবে?

১০ স্বাধীন ইচ্ছা সমেত মানুষকে সৃষ্টি করা হয়, অর্থাৎ বেছে নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাদের রোবোট বা জন্তুদের মত সৃষ্টি করা হয়নি, যারা মুখ্যত সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই মানুষ কাকে সেবা করবে তা বেছে নিতে পারে। (দ্বিতীয় বিবরণ ৩০:১৯; ২ করিন্থীয় ৩:১৭) ফলে, ঈশ্বরের বাক্য পরামর্শ দেয়: “আপনাদিগকে স্বাধীন জান; আর স্বাধীনতাকে দুষ্টতার আবরণ করিও না, কিন্তু আপনাদিগকে ঈশ্বরের দাস জান।” (১ পিতর ২:১৬) যাইহোক, স্বাধীনভাবে বেছে নেওয়ার অপূর্ব উপহার মানুষের থাকলেও, তাদের নিজেদের বেছে নেওয়া কাজের প্রতিফল তাদের গ্রহণ করতেই হবে।

১১ আমাদের প্রথম পিতামাতা ভুলটি বেছে নেয়। ঈশ্বরের থেকে স্বাধীন হওয়ার পথ তারা বেছে নেয়। এটি সত্য যে, তাদের স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করাতে, বিদ্রোহী প্রথম দম্পতিকে ঈশ্বর তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলতে পারতেন। কিন্তু সেটি মানুষের উপরে ঈশ্বরের শাসন করার ক্ষমতার প্রশ্নটির নিষ্পত্তি করত না। যেহেতু প্রথম দম্পতি ঈশ্বরের থেকে স্বাধীন হতে চেয়েছিল তাই এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া উচিৎ: সেই পথ কি আনন্দময়, সফল জীবন দিতে পারবে? উত্তর খুঁজে পাওয়ার একমাত্র উপায় হল, আমাদের প্রথম পিতামাতা ও তাদের সন্তানসন্ততিদের নিজেদের পথে চলতে দেওয়া, কারণ সেটাই তারা বেছে নিয়েছিল। তাদের সৃষ্টিকর্তা থেকে স্বাধীন হয়ে সফলভাবে নিজেদের শাসন করার জন্যই মানুষেরা সৃষ্ট হয়েছিল কি না তা সময়ই প্রদর্শন করবে।

১২ বাইবেল লেখক যিরমিয় জানতেন ফলাফল কী হবে। ঈশ্বরের পবিত্র আত্মা বা সক্রিয় শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে, তিনি নিষ্ঠার সাথে লেখেন: “হে সদাপ্রভু, আমি জানি, মনুষ্যের পথ তাহার বশে নয়, মনুষ্য চলিতে চলিতে আপন পাদবিক্ষেপ স্থির করিতে পারে না। হে সদাপ্রভু, আমাকে শাসন কর।” (যিরমিয় ১০:২৩, ২৪) তিনি জানতেন যে মানুষের ঈশ্বরের স্বর্গীয় প্রজ্ঞার পরিচালনা প্রয়োজন। কেন? খুবই সাধারণ, কারণ ঈশ্বরের পরিচালনা ব্যতিরেকে সফল হওয়ার জন্য তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেননি।

১৩ হাজার হাজার বছরের মানুষের শাসনের ফলাফল নিঃসন্দেহে দেখায় যে সৃষ্টিকর্তা বিনা কোন কিছুর পরিচালনা করা মানুষের অসাধ্য। এইভাবে চেষ্টা করে, তারা এই সর্বনাশা ফলাফলের জন্য একমাত্র নিজেদেরই দোষ দিতে পারে। বাইবেল এটি স্পষ্ট করে: “তিনি শৈল [ঈশ্বর], তাঁহার কর্ম্ম সিদ্ধ, কেননা তাঁহার সমস্ত পথ ন্যায্য; তিনি বিশ্বাস্য ঈশ্বর, তাঁহাতে অন্যায় নাই; তিনিই ধর্ম্মময় ও সরল। ইহারা তাঁহার সম্বন্ধে ভ্রষ্টাচারী, তাঁহার সন্তান নয়, এই ইহাদের কলঙ্ক।”—দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪, ৫.

শীঘ্রই ঈশ্বর হস্তক্ষেপ করবেন

১৪ শতাব্দীব্যাপী মানব শাসনের ব্যর্থতা প্রদর্শনের অনেক সুযোগ দিয়ে, ঈশ্বর এখন মানুষের বিষয়ে হস্তক্ষেপ শুরু করতে পারেন এবং দুঃখকষ্ট, বেদনা, অসুস্থতা এবং মৃত্যু শেষ করতে পারেন। বিজ্ঞান, শিল্প, ঔষধ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মানুষকে সফলতার শীর্ষে আসতে সুযোগ দেওয়ার পর, ঈশ্বরের এখন আর স্রষ্টা থেকে স্বাধীন মানুষকে, এক শান্তিপূর্ণ, পরমদেশীয় জগৎ আনতে পারে কি না তা প্রদর্শন করতে, আরও কিছু শতাব্দী সময় দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। তারা আনতে পারেনি আর পারবেও না। ঈশ্বরের থেকে স্বাধীন হওয়াতে এক অতি কুৎসিৎ, বিদ্বেষপূর্ণ, মারাত্মক জগতের সৃষ্টি হয়েছে।

১৫ যদিও নিষ্ঠাবান শাসকগণও ছিলেন, যারা মানবজাতিকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। মানব শাসনের ব্যর্থতার প্রমাণ প্রত্যেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে। সেই কারণেই বাইবেল পরামর্শ দেয়: “তোমরা নির্ভর করিও না রাজন্যগণে, বা মনুষ্য-সন্তানে, যাহার নিকটে ত্রাণ নাই। তাহার শ্বাস নির্গত হয়, সে নিজ মৃত্তিকায় প্রতিগমন করে; সেই দিনেই তাহার সঙ্কল্প সকল নষ্ট হয়।”—গীতসংহিতা ১৪৬:৩.

[অধ্যয়ন প্রশ্নাবলি]

১, ২. মানবের অভিজ্ঞতার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে, কী প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে?

৩-৫. (ক) শৃঙ্খলার ঈশ্বর পৃথিবীতে কেন বিশৃঙ্খলা থাকতে দিয়েছেন তা বুঝতে আমাদের কোন্‌ উদাহরণটি সাহায্য করবে? (খ) কিছু বিকল্পগুলির মধ্যে কোন্‌টি পৃথিবীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?

৬, ৭. ঈশ্বরের নিয়ম ভঙ্গ করাতে আদম ও হবার কী হয়েছিল?

৮. আমাদের প্রথম পিতামাতার পাপ কিভাবে মানব পরিবারকে প্রভাবিত করে?

৯. ঈশ্বর এতদিন ধরে দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন কেন?

১০. মানুষকে কোন্‌ ক্ষমতা দেওয়া হয়, কোন্‌ দায়িত্বভারের সাথে?

১১. ঈশ্বর থেকে স্বাধীন পথ সফল হবে কি না তা একমাত্র কিভাবে জানা যেতে পারে?

১২. মানব শাসনকে যিরমিয় কিভাবে মূল্যায়ন করেন এবং কেন তা এরূপ?

১৩. হাজার হাজার বছরের মানব শাসনের ফলাফল সন্দেহাতীতরূপে কী প্রদর্শন করে?

১৪. মানুষের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে ঈশ্বর আর দেরী করবেন না কেন?

১৫. বাইবেলের কোন্‌ পরামর্শ আমাদের শোনা উচিৎ?

[২৪, ২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

এমন কি নিষ্ঠাবান জাগতিক শাসকেরাও এক শান্তিপূর্ণ, পরমদেশীয় জগৎ আনতে সক্ষম হননি