অধ্যায় ১২
“ঈশ্বরে কি অন্যায় আছে?”
১. অবিচারের ঘটনাগুলোর দ্বারা আমরা কীভাবে প্রভাবিত হতে পারি?
একজন বয়স্কা বিধবাকে ঠকিয়ে তার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক অসহায় শিশুকে ফেলে রেখে তার পাষাণহৃদয়ের মা চলে গেছে। একজন ব্যক্তিকে এমন এক অপরাধের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যেটা আসলে সে করেনি। এই ঘটনাগুলো সম্বন্ধে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? সম্ভবত প্রতিটা ঘটনাই আপনাকে ক্ষুব্ধ করে আর তা স্বাভাবিক। আমাদের মানুষদের ন্যায়-অন্যায় সম্বন্ধে এক দৃঢ় বোধশক্তি রয়েছে। যখন অন্যায় বা অবিচার করা হয় তখন আমরা রেগে যাই। আমরা চাই যে, যার প্রতি অবিচার করা হয়েছে তাকে যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় ও অপরাধীর যেন শাস্তি হয়। যদি তা না হয়, তা হলে আমরা হয়তো ভাবতে পারি: ‘কী ঘটছে তা কি ঈশ্বর আদৌ দেখেন? কেন তিনি কিছু করেন না?’
২. অবিচারের প্রতি হবক্কূক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন এবং কেন যিহোবা এর জন্য তাকে ভর্ৎসনা করেননি?
২ ইতিহাস জুড়ে, যিহোবার বিশ্বস্ত দাসেরা একইরকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ভাববাদী হবক্কূক ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন: “কেন তুমি আমাকে এইরকম প্রচণ্ড অবিচার দেখাচ্ছ? কেন তুমি দৌরাত্ম্য, অরাজকতা, অপরাধ ও নিষ্ঠুরতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছ?” (হবক্কূক ১:৩, কনটেমপোরারি ইংলিশ ভারসন) যিহোবা হবক্কূকের অকপট প্রশ্নের জন্য তাকে ভর্ৎসনা করেননি কারণ তিনি নিজেই মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচারের ধারণা স্থাপন করেছেন। হ্যাঁ, যিহোবা তাঁর ন্যায়বিচারের গভীর অনুভূতির এক ক্ষুদ্র অংশ আমাদের মধ্যে দিয়েছেন।
যিহোবা অবিচার ঘৃণা করেন
৩. কেন বলা যেতে পারে যে, অবিচার সম্বন্ধে যিহোবা আমাদের চেয়ে আরও বেশি অবগত আছেন?
৩ যিহোবা অবিচার সম্বন্ধে অজ্ঞাত নন। কী ঘটছে না ঘটছে, তা তিনি দেখেন। নোহের দিন সম্বন্ধে বাইবেল আমাদের বলে: “সদাপ্রভু দেখিলেন, পৃথিবীতে মনুষ্যের দুষ্টতা বড়, এবং তাহার অন্তঃকরণের চিন্তার সমস্ত কল্পনা নিরন্তর কেবল মন্দ।” (আদিপুস্তক ৬:৫) সেই বিবৃতির তাৎপর্য বিবেচনা করুন। প্রায়ই, অবিচার সম্বন্ধে আমাদের ধারণা কিছু ঘটনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, যেগুলো হয় আমরা শুনেছি বা ব্যক্তিগতভাবে সেগুলোর মুখোমুখি হয়েছি। এর বিপরীতে, যিহোবা বিশ্বব্যাপী ঘটে চলা অবিচার সম্বন্ধে অবগত আছেন। তিনি সবকিছু দেখতে পান! এর চেয়েও বড় কথা হল যে, তিনি হৃদয়ের প্রবণতাগুলো—অন্যায্য কাজের পিছনের খারাপ চিন্তা—সম্বন্ধে জানেন।—যিরমিয় ১৭:১০.
৪, ৫. (ক) বাইবেল কীভাবে দেখায় যে, যাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে তাদের জন্য যিহোবা চিন্তা করেন? (খ) কীভাবে যিহোবা নিজেই অবিচারের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন?
৪ কিন্তু, যিহোবা শুধু অবিচার লক্ষ করার চেয়েও আরও বেশি কিছু করেন। যারা এর শিকার হয়, তাদের জন্যও তিনি চিন্তা করেন। যিহোবার লোকেদের সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ জাতিগুলো যখন নিষ্ঠুর আচরণ করত, তখন তিনি “উপদ্রব ও তাড়নাকারিগণের সমক্ষে তাহাদের কাতরোক্তি প্রযুক্ত” কষ্ট পেতেন। (বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ ২:১৮) আপনি হয়তো লক্ষ করেছেন যে, কিছু লোক যত বেশি অবিচার দেখে, তত বেশি তারা এর প্রতি অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে। যিহোবার বেলায় তা হয় না! তিনি প্রায় ৬,০০০ বছর ধরে অবিচারের সম্পূর্ণ পরিধি দেখেছেন, অথচ এর প্রতি তাঁর ঘৃণা এখনও অব্যাহত রয়েছে। স্পষ্টতই, বাইবেল আমাদের আশ্বাস দেয় যে, “মিথ্যাবাদী জিহ্বা,” “নির্দ্দোষের রক্তপাতকারী হস্ত” এবং “যে মিথ্যাসাক্ষী অসত্য কথা কহে,” তা তিনি ঘৃণা করেন।—হিতোপদেশ ৬:১৬-১৯.
৫ এ ছাড়া, ইস্রায়েলের ন্যায়পরায়ণহীন নেতাদের প্রতি যিহোবার দৃঢ় ভর্ৎসনার কথা বিবেচনা করুন। তিনি তাঁর ভাববাদীকে তাদের জিজ্ঞেস করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন: “ন্যায়বিচার জ্ঞাত হওয়া কি তোমাদের উচিত নয়?” তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার সম্বন্ধে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করার পর, যিহোবা এই কলুষিত ব্যক্তিদের পরিণতি সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন: “তাহারা সদাপ্রভুর কাছে ক্রন্দন করিবে, কিন্তু তিনি তাহাদিগকে উত্তর দিবেন না; বরং তাহারা যেমন আপনাদের ব্যবহারে দুষ্ক্রিয়া করিয়াছে, তেমনি তিনি সেই সময়ে তাহাদের হইতে আপন মুখ লুকাইবেন।” (মীখা ৩:১-৪) অবিচারের প্রতি যিহোবার কতই না বিরূপ মনোভাব রয়েছে! কেননা, স্বয়ং তাঁর সরাসরি এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল! হাজার হাজার বছর ধরে, শয়তান অন্যায়ভাবে তাঁকে টিটকারি দিয়ে আসছে। (হিতোপদেশ ২৭:১১) এ ছাড়া, সবচেয়ে ভয়ানক অবিচার যিহোবাকে প্রভাবিত করেছিল, যখন তাঁর পুত্র যিনি কোনো “পাপ করেন নাই,” কিন্তু তাঁকে একজন অপরাধী হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। (১ পিতর ২:২২; যিশাইয় ৫৩:৯) অতএব এটা স্পষ্ট যে, যারা অবিচার ভোগ করছে তাদের অবস্থা সম্বন্ধে যিহোবা অজ্ঞাত বা উদাসীন কোনোটাই নন।
৬. অবিচারের মুখোমুখি হলে আমরা হয়তো কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাই এবং কেন?
৬ অতএব, আমরা যখন অবিচার দেখি—বা নিজেরাই যখন অন্যায় আচরণের শিকার হই—তখন খুব জোরালোভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো স্বাভাবিক। ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে আমাদের তৈরি করা হয়েছে আর অবিচার সেই সমস্ত বিষয়ের পুরোপুরি বিপরীত, যেগুলো যিহোবাকে প্রতিনিধিত্ব করে। (আদিপুস্তক ১:২৭) তা হলে, কেন ঈশ্বর অবিচার থাকতে দিচ্ছেন?
ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধীয় বিচার্য বিষয়
৭. যিহোবার সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে কীভাবে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, তা বর্ণনা করুন।
৭ এই প্রশ্নের উত্তরটা সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধীয় বিচার্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা দেখেছি যে, পৃথিবী ও এখানে যারা বাস করে তাদের সকলের ওপর শাসন করার অধিকার সৃষ্টিকর্তার রয়েছে। (গীতসংহিতা ২৪:১; প্রকাশিত বাক্য ৪:১১) কিন্তু, মানব ইতিহাসের প্রথম দিকে যিহোবার সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। এটা কীভাবে ঘটেছিল? প্রথম মানব আদমকে যিহোবা আদেশ দিয়েছিলেন যে, সে যেন তার পরমদেশ গৃহের উদ্যানের একটা নির্দিষ্ট গাছের ফল না খায়। যদি সে অবাধ্য হয়, তা হলে কী হবে? ঈশ্বর তাকে বলেছিলেন: “মরিবেই মরিবে।” (আদিপুস্তক ২:১৭) ঈশ্বরের আদেশ আদম ও তার স্ত্রী হবার জন্য কষ্টকর কিছু ছিল না। তা সত্ত্বেও, হবার মধ্যে শয়তান এই প্রত্যয় জন্মিয়েছিল যে, ঈশ্বর অত্যধিক নিয়ন্ত্রণপ্রবণ। সে যদি সেই গাছের ফল খায়, তা হলে কী হবে? শয়তান সরাসরি হবাকে বলেছিল: “কোন ক্রমে মরিবে না; কেননা ঈশ্বর জানেন, যে দিন তোমরা তাহা খাইবে, সেই দিন তোমাদের চক্ষু খুলিয়া যাইবে, তাহাতে তোমরা ঈশ্বরের সদৃশ হইয়া সদসদ্-জ্ঞান প্রাপ্ত হইবে।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—আদিপুস্তক ৩:১-৫.
৮. (ক) শয়তান হবাকে বলা তার কথার দ্বারা পরোক্ষভাবে কী ইঙ্গিত করেছিল? (খ) ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে শয়তান কোন প্রশ্ন তুলেছিল?
৮ এই কথা বলে শয়তান পরোক্ষভাবে শুধু এই ইঙ্গিতই দেয়নি যে, হবার কাছ থেকে যিহোবা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন রেখেছেন কিন্তু সেইসঙ্গে এও বলেছিল যে, তিনি হবাকে মিথ্যা বলেছেন। ঈশ্বর যে সার্বভৌম শাসক সেই বাস্তব সত্য নিয়ে শয়তান কোনো প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু সে এর বৈধতা, যোগ্যতা ও ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। অন্য কথায় সে দাবি করেছিল যে, যিহোবা তাঁর সার্বভৌমত্ব ন্যায্যভাবে এবং তাঁর প্রজাদের মঙ্গলের জন্য ব্যবহার করছিলেন না।
৯. (ক) আদম ও হবার অবাধ্যতার ফল কী হয়েছিল এবং এটা কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেছিল? (খ) কেন যিহোবা বিদ্রোহীদের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস করেননি?
৯ পরে, আদম ও হবা দুজনেই নিষিদ্ধ গাছ থেকে ফল খেয়ে যিহোবার অবাধ্য হয়েছিল। তাদের অবাধ্যতা তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য করেছিল, ঠিক যেমন ঈশ্বর বলেছিলেন। শয়তানের মিথ্যা কথা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। মানবজাতিকে শাসন করার জন্য যিহোবার কি সত্যিই অধিকার রয়েছে নাকি মানুষ নিজেই নিজেকে শাসন করবে? যিহোবা কি তাঁর সার্বভৌমত্ব সর্বোত্তম উপায়ে ব্যবহার করেন? যিহোবা সেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য তাঁর অসীম শক্তি ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু যে-প্রশ্নগুলো উঠেছিল, সেগুলো ঈশ্বরের শাসন করার অধিকারের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত ছিল, তাঁর শক্তির সঙ্গে নয়। তাই আদম, হবা ও শয়তানকে ধ্বংস করে দেওয়া ঈশ্বরের শাসনের ন্যায্যতাকে প্রমাণ করত না। বরং, এটা তাঁর শাসন করার অধিকার নিয়ে আরও বেশি প্রশ্নের উত্থাপন করত। মানুষেরা ঈশ্বরের কাছ থেকে স্বাধীন হয়ে নিজেরা নিজেদের সফলভাবে শাসন করতে পারে কি না, তা নির্ণয় করার একমাত্র উপায় ছিল আরও সময় দেওয়া।
১০. মানব শাসন সম্বন্ধে ইতিহাস কী প্রকাশ করেছে?
১০ সময় অতিবাহিত হওয়ায় কী প্রকাশ পেয়েছে? হাজার হাজার বছর ধরে, লোকেরা একনায়কতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ সহ বিভিন্ন ধরনের সরকার পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা করেছে। সেগুলোর সার্বিক ফলাফল বাইবেলের স্পষ্ট মন্তব্যে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে: “এক জন অন্যের উপরে তাহার অমঙ্গলার্থে কর্ত্তৃত্ব করে।” (উপদেশক ৮:৯) উপযুক্ত কারণেই, ভাববাদী যিরমিয় বলেছিলেন: “হে সদাপ্রভু আমি জানি, মনুষ্যের পথ তাহার বশে নয়, মনুষ্য চলিতে চলিতে আপন পাদবিক্ষেপ স্থির করিতে পারে না।”—যিরমিয় ১০:২৩.
১১. কেন যিহোবা মানবজাতিকে কষ্টভোগের অধীনে আসতে দিয়েছিলেন?
১১ যিহোবা শুরু থেকে জানতেন যে, মানবজাতির স্বাধীনতা বা স্বশাসন অনেক দুঃখকষ্ট নিয়ে আসবে। তা হলে, এই অপরিহার্য খারাপ পরিস্থিতিকে চলতে দেওয়া কি তাঁর পক্ষে অন্যায্য ছিল? কখনোই না! উদাহরণস্বরূপ: ধরুন আপনার সন্তানের একটা মারাত্মক রোগ থেকে সুস্থ হওয়ার জন্য অপারেশনের দরকার আছে। আপনি জানেন যে, এই অপারেশন আপনার সন্তানকে অনেক কষ্ট দেবে আর তা আপনাকে গভীরভাবে দুঃখিত করে। একই সময়ে, আপনি জানেন যে এই প্রক্রিয়াটা আপনার সন্তানকে পরবর্তী জীবনে ভাল স্বাস্থ্য উপভোগ করতে সাহায্য করবে। ঠিক একইভাবে, ঈশ্বর জানতেন—আর এমনকি ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন—মানব শাসন চলতে দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর অনুমোদন অনেক ব্যথা ও দুঃখকষ্ট নিয়ে আসবে। (আদিপুস্তক ৩:১৬-১৯) কিন্তু তিনি এও জানতেন যে, স্থায়ী ও অর্থপূর্ণ স্বস্তি একমাত্র তখনই আসবে, যদি তিনি সমস্ত মানবজাতিকে বিদ্রোহের দ্বারা উৎপন্ন খারাপ ফল ভোগ করতে দেন। এভাবে সেই বিচার্য বিষয়টা স্থায়ীভাবে, চিরদিনের জন্য সমাধান করা যেত।
মানুষের নীতিনিষ্ঠা সম্বন্ধীয় বিচার্য বিষয়
১২. ইয়োবের ঘটনায় যেমন দেখানো হয়েছে, মানুষের বিরুদ্ধে শয়তান কোন অভিযোগ এনেছিল?
১২ এই বিষয়টার আরেকটা দিক রয়েছে। ঈশ্বরের শাসনের বৈধতা ও ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে, শয়তান শুধু যিহোবার সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে অপবাদই দেয়নি; সে ঈশ্বরের দাসদের নীতিনিষ্ঠা সম্বন্ধেও অপবাদ দিয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে, ধার্মিক ব্যক্তি ইয়োব সম্বন্ধে যিহোবাকে শয়তান কী বলেছিল, তা লক্ষ করুন: “তুমি তাহার চারিদিকে, তাহার বাটীর চারিদিকে ও তাহার সর্ব্বস্বের চারিদিকে কি বেড়া দেও নাই? তুমি তাহার হস্তের কার্য্য আশীর্ব্বাদযুক্ত করিয়াছ, এবং তাহার পশুধন দেশময় ব্যাপিয়াছে। কিন্তু তুমি একবার হস্ত বিস্তার করিয়া তাহার সর্ব্বস্ব স্পর্শ কর, তবে সে অবশ্য তোমার সম্মুখেই তোমাকে জলাঞ্জলি দিবে।”—ইয়োব ১:১০, ১১.
১৩. ইয়োব সম্বন্ধে শয়তান তার অভিযোগের মাধ্যমে কী ইঙ্গিত করেছিল এবং এটা কীভাবে সমস্ত মানুষকে জড়িত করে?
১৩ শয়তান তর্ক করেছিল যে, যিহোবা তাঁর প্রতিরক্ষামূলক শক্তি ইয়োবের ভক্তি কেনার জন্য ব্যবহার করছিলেন। অন্যদিকে এটা ইঙ্গিত করেছিল যে, ইয়োবের নীতিনিষ্ঠা শুধুই কপটতাপূর্ণ ছিল, তিনি শুধুমাত্র বিনিময়ে কিছু পাওয়ার জন্য ঈশ্বরের উপাসনা করেছিলেন। শয়তান দাবি করেছিল যে, ইয়োবের ওপর থেকে যদি ঈশ্বরের আশীর্বাদ উঠিয়ে নেওয়া হয়, তা হলে এমনকি এই ব্যক্তি তার সৃষ্টিকর্তাকে অভিশাপ দেবেন। শয়তান জানত যে, ইয়োব “সিদ্ধ ও সরল, ঈশ্বরভয়শীল ও কুক্রিয়াত্যাগী লোক” হিসেবে খ্যাত ছিলেন। a তাই শয়তান যদি ইয়োবের নীতিনিষ্ঠা ভাঙতে পারত, তা হলে বাকি মানবজাতির জন্য তা কী ইঙ্গিত করত? এভাবে শয়তান আসলে যারা ঈশ্বরের সেবা করতে চায়, তাদের সকলের আনুগত্য সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছিল। বাস্তবিকপক্ষে, বিচার্য বিষয়টাকে আরেকটু প্রসারিত করে, শয়তান যিহোবাকে বলেছিল: “প্রাণের জন্য লোক [শুধুমাত্র ইয়োব নয়] সর্ব্বস্ব দিবে।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—ইয়োব ১:৮; ২:৪.
১৪. মানুষের বিরুদ্ধে শয়তানের অভিযোগ সম্বন্ধে ইতিহাস কী দেখিয়েছে?
১৪ ইতিহাস দেখিয়েছে যে, শয়তানের দাবির বিপরীতে ইয়োবের মতো অনেকে পরীক্ষার মুখে যিহোবার প্রতি অনুগত ছিল। তারা তাদের বিশ্বস্ত জীবনধারার মাধ্যমে যিহোবার হৃদয় আনন্দিত করেছে আর এটা মানুষ কষ্টের মধ্যে পড়লে ঈশ্বরের সেবা করা বন্ধ করে দেবে, শয়তানের এই দাম্ভিক উপহাসের প্রতি যিহোবাকে এক উত্তর জুগিয়েছে। (ইব্রীয় ১১:৪-৩৮) হ্যাঁ, সৎহৃদয়ের লোকেরা ঈশ্বরকে অগ্রাহ্য করা প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি চরম দুর্দশামূলক পরিস্থিতিতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেও, তারা স্থির থাকার শক্তির জন্য যিহোবার ওপর আরও বেশি করে নির্ভর করেছে।—২ করিন্থীয় ৪:৭-১০.
১৫. ঈশ্বরের অতীত ও ভবিষ্যৎ বিচারগুলো সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন উঠতে পারে?
১৫ কিন্তু যিহোবার ন্যায়বিচার অনুশীলনের সঙ্গে সার্বভৌমত্ব ও মানুষের নীতিনিষ্ঠা সম্বন্ধীয় বিচার্য বিষয়গুলোর চেয়ে আরও বেশি কিছু জড়িত। বাইবেল আমাদের ব্যক্তিবিশেষদের ও এমনকি সমগ্র জাতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যিহোবার বিচার সম্বন্ধে এক নথি জোগায়। এ ছাড়া, এতে ভবিষ্যতে তিনি যে-বিচারগুলো করবেন, সেই সম্বন্ধেও ভবিষ্যদ্বাণীগুলো রয়েছে। আমরা কেন আস্থা রাখতে পারি যে, যিহোবা তাঁর বিচারে ন্যায্য ছিলেন এবং থাকবেন?
যেকারণে ঈশ্বরের বিচার সর্বশ্রেষ্ঠ
১৬, ১৭. কোন উদাহরণগুলো দেখায় যে, প্রকৃত ন্যায়বিচার সম্বন্ধে মানুষের এক সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে?
১৬ যিহোবার সম্বন্ধে এটা উপযুক্তভাবেই বলা যেতে পারে: “তাঁহার সমস্ত পথ ন্যায্য।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪) আমাদের মধ্যে কেউই নিজেদের সম্বন্ধে এইরকম দাবি করতে পারি না কারণ প্রায়ই আমাদের সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি যা সঠিক, তা উপলব্ধি করার শক্তিকে ম্লান করে ফেলে। উদাহরণ হিসেবে, অব্রাহামের কথা বিবেচনা করুন। সদোমের অবাধ দুষ্টতা সত্ত্বেও, তিনি সেই নগরের ধ্বংস সম্বন্ধে যিহোবার কাছে মিনতি করেছিলেন। তিনি যিহোবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “আপনি কি দুষ্টের সহিত ধার্ম্মিককেও সংহার করিবেন?” (আদিপুস্তক ১৮:২৩-৩৩) অবশ্যই, এর উত্তর ছিল, না। ধার্মিক লোট ও তার মেয়েরা যখন নিরাপদে সোয়র নগরে পৌঁছেছিল, একমাত্র তখনই যিহোবা সদোমের ওপর ‘গন্ধক ও অগ্নি বর্ষণ’ করেছিলেন। (আদিপুস্তক ১৯:২২-২৪) অন্যদিকে, ঈশ্বর যখন নীনবীর লোকেদের প্রতি করুণা দেখিয়েছিলেন, তখন যোনা “ক্রুদ্ধ” হয়েছিলেন। যেহেতু যোনা ইতিমধ্যে তাদের ধ্বংস সম্বন্ধে ঘোষণা করেছিলেন, তাই তাদের আন্তরিক অনুতাপ সত্ত্বেও, তাদের ধ্বংস দেখে তিনি খুশি হতেন।—যোনা ৩:১০–৪:১.
১৭ যিহোবা অব্রাহামকে পুনরায় আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তাঁর ন্যায়বিচার অনুশীলনের মধ্যে শুধু দুষ্টদের ধ্বংসই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে ধার্মিকদের রক্ষাও অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, যোনাকে শিখতে হয়েছিল যে, যিহোবা করুণাময়। দুষ্টরা যদি তাদের পথ পরিবর্তন করে, তা হলে তিনি “ক্ষমা করার জন্য তৈরি।” (গীতসংহিতা ৮৬:৫, NW) নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন এমন কিছু মানুষের বৈসাদৃশ্যে, যিহোবা শুধু তাঁর শক্তি জাহির করার জন্য কঠোর বিচার করেন না বা তাঁকে দুর্বল মনে করা হবে, এই ভয়ে তিনি সমবেদনা দেখানো থেকেও বিরত থাকেন না। তাঁর বৈশিষ্ট্যই হল করুণা দেখানো, যখন তা দেখানোর উপযুক্ত কারণ থাকে।—যিশাইয় ৫৫:৭; যিহিষ্কেল ১৮:২৩.
১৮. বাইবেল থেকে দেখান যে যিহোবা নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে কাজ করেন না।
১৮ কিন্তু, যিহোবা নিছক আবেগের দ্বারা অন্ধ নন। তাঁর লোকেরা যখন প্রতিমাপূজায় একেবারে ডুবে গিয়েছিল, তখন যিহোবা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছিলেন: “আমি . . . তোমার আচারানুসারে বিচার করিব, তোমার সমস্ত ঘৃণার্হ কার্য্যের ফল তোমার উপরে রাখিব। আমি তোমার প্রতি চক্ষুলজ্জা করিব না, দয়াও করিব না, কিন্তু তোমার কার্য্যের ফল তোমার উপরে রাখিব।” (যিহিষ্কেল ৭:৩, ৪) তাই মানুষেরা যখন রূঢ় আচরণ করে, তখন যিহোবা সেই অনুযায়ী বিচার করেন। তবে তাঁর বিচার সঠিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে হয়। তাই, সদোম ও ঘমোরা সম্বন্ধে এক প্রবল “ক্রন্দন” যখন যিহোবার কানে পৌঁছেছিল, তখন তিনি বলেছিলেন: “আমি নীচে গিয়া দেখিব, আমার নিকটে আগত ক্রন্দনানুসারে তাহারা সর্ব্বতোভাবে করিয়াছে কি না।” (আদিপুস্তক ১৮:২০, ২১) আমরা কতই না আনন্দিত যে, যিহোবা এমন অনেক মানুষের মতো নন, যারা সমস্ত ঘটনা শোনার আগেই তাড়াহুড়ো করে বিচার করে! সত্যিই, বাইবেল যিহোবাকে যেভাবে বর্ণনা করে তিনি ঠিক তেমনই একজন “বিশ্বাস্য ঈশ্বর, তাঁহাতে অন্যায় নাই।”—দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪.
যিহোবার ন্যায়বিচারের ওপর আস্থা রাখুন
১৯. যিহোবার ন্যায়বিচার অনুশীলন সম্বন্ধে আমাদের যদি হতবুদ্ধিকর প্রশ্ন থাকে, তা হলে আমরা কী করতে পারি?
১৯ বাইবেল যিহোবার অতীতের কাজ সম্বন্ধে প্রতিটা প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করে না; কিংবা ভবিষ্যতে যিহোবা ব্যক্তিবিশেষদের বা দলগুলোর কীভাবে বিচার করবেন, সেই সম্বন্ধে প্রতিটা বিষয়ও এটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানায় না। আমরা যখন বাইবেলের সেই বিবরণ বা ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পড়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি যেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা নেই, তখন আমরা ভাববাদী মীখার মতো একইরকম আনুগত্য দেখাতে পারি, যিনি লিখেছিলেন: “আমি . . . আমার ত্রাণেশ্বরের অপেক্ষা করিব।”—মীখা ৭:৭.
২০, ২১. কেন আমরা আস্থা রাখতে পারি যে, যিহোবা সবসময় যা সঠিক তা-ই করবেন?
২০ আমরা আস্থা রাখতে পারি যে, যিহোবা প্রতিটা ক্ষেত্রেই যা সঠিক ঠিক তা-ই করবেন। এমনকি যখন মানুষ অবিচারগুলোকে উপেক্ষা করছে বলে মনে হয়, তখন যিহোবা প্রতিজ্ঞা করেন: “প্রতিশোধ লওয়া আমারই কর্ম্ম, আমিই প্রতিফল দিব।” (রোমীয় ১২:১৯) আমরা যদি অপেক্ষার মনোভাব দেখাই, তা হলে প্রেরিত পৌল যে-দৃঢ়প্রত্যয় প্রকাশ করেছিলেন, তা প্রতিধ্বনিত করতে পারব: “ঈশ্বরে কি অন্যায় আছে? তাহা দূরে থাকুক।”—রোমীয় ৯:১৪.
২১ এখন আমরা ‘বিষম সময়ে’ বাস করছি। (২ তীমথিয় ৩:১) অবিচার ও ‘উপদ্রবের’ কারণে অনেক নিষ্ঠুর অপব্যবহার হয়েছে। (উপদেশক ৪:১) কিন্তু, যিহোবার পরিবর্তন হয়নি। তিনি এখনও অবিচার ঘৃণা করেন আর যারা এর শিকার হয় তাদের জন্য তিনি গভীরভাবে চিন্তা করেন। আমরা যদি যিহোবা ও তাঁর সার্বভৌমত্বের প্রতি অনুগত থাকি, তা হলে তিনি আমাদের সেই নিরূপিত সময় পর্যন্ত স্থির থাকতে শক্তি দেবেন, যখন তিনি তাঁর রাজ্যের অধীনে সমস্ত অবিচার দূর করবেন।—১ পিতর ৫:৬, ৭.