সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় ১১

“তাঁহার সমস্ত পথ ন্যায্য”

“তাঁহার সমস্ত পথ ন্যায্য”

১, ২. (ক) যোষেফ কোন চরম অবিচারগুলো ভোগ করেছিলেন? (খ) যিহোবা কীভাবে অবিচারগুলো থেকে তাকে মুক্ত করেছিলেন?

এটা ছিল চরম অবিচার। একজন সুদর্শন যুবক কোনো অপরাধ করেননি কিন্তু তারপরও ধর্ষণ করতে চেষ্টা করার এক মিথ্যা অভিযোগে মাটির নিচে অন্ধকার এক কারাগারে বন্দি ছিলেন। তবে, তিনি এই প্রথম অবিচার ভোগ করছিলেন না। কয়েক বছর আগে, ১৭ বছর বয়সী এই যুবক যোষেফের সঙ্গে তার নিজের ভাইয়েরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, যারা তাকে প্রায় মেরেই ফেলছিল। পরে তাকে বিদেশে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তিনি তার প্রভুর স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এই প্রত্যাখ্যাত নারী তাকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন আর এভাবেই তিনি কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় হল যে, যোষেফের পক্ষে কথা বলার মতো কেউই নেই বলে মনে হয়েছিল।

যোষেফ “কারাকূপে” অন্যায়ভাবে কষ্টভোগ করেছিলেন

কিন্তু, ঈশ্বর যিনি “ধার্ম্মিকতা ও ন্যায়বিচার ভালবাসেন,” তিনি তা দেখছিলেন। (গীতসংহিতা ৩৩:৫) যিহোবা অবিচার থেকে তাকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, ঘটনাগুলো এমনভাবে ঘটিয়েছিলেন যেকারণে যোষেফ শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছিলেন। এর চেয়েও বড় বিষয় হল যে, যোষেফকে—যাকে “কারাকূপে” নিক্ষেপ করা হয়েছিল—শেষ পর্যন্ত এক বিরাট দায়িত্ব এবং অসাধারণ সম্মানজনক পদ দেওয়া হয়েছিল। (আদিপুস্তক ৪০:১৫; ৪১:৪১-৪৩; গীতসংহিতা ১০৫:১৭, ১৮) সবশেষে যোষেফ নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন এবং তিনি তার উচ্চপদ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করেছিলেন।—আদিপুস্তক ৪৫:৫-৮.

৩. কেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, আমরা সবাই চাই যেন আমাদের সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করা হোক?

এইরকম একটা বিবরণ আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়, তাই নয় কি? আমাদের মধ্যে কে অবিচার দেখেনি বা এর শিকার হয়নি? বাস্তবিকই, আমরা সবাই চাই যে আমাদের সঙ্গে ন্যায্য ও পক্ষপাতহীন আচরণ করা হোক। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই কারণ যিহোবা আমাদের যে-গুণগুলো দিয়েছেন, সেগুলো তাঁর নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রতিফলিত করে আর ন্যায়বিচার তাঁর মুখ্য গুণগুলোর একটা। (আদিপুস্তক ১:২৭) যিহোবাকে ভালভাবে জানার জন্য তিনি ন্যায়বিচারকে যেভাবে দেখেন, তা আমাদের বোঝা দরকার। এভাবে আমরা তাঁর চমৎকার পথগুলো আরও বেশি উপলব্ধি করার এবং তাঁর আরও নিকটবর্তী হওয়ার জন্য চালিত হতে পারি।

ন্যায়বিচার কী?

৪. মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে, ন্যায়বিচারকে প্রায়ই কীভাবে বোঝা হয়?

মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে, ন্যায়বিচারকে প্রায়ই শুধু আইনের শাসনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ বলে মনে করা হয়। ন্যায় ও বিচারশক্তি—তত্ত্ব ও চর্চায় নীতিমালা (ইংরেজি) বইটি বলে যে, “ন্যায়বিচার আইন, আইনগত বাধ্যবাধকতা, অধিকার ও কর্তব্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আর এর চূড়ান্ত রায়গুলোকে পক্ষপাতহীনতা বা দোষগুণ অনুযায়ী পরিমাপ করা হয়।” কিন্তু, যিহোবার ন্যায়বিচার কর্তব্য বা নৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্য নিয়মগুলো যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করার চেয়ে আরও বেশি কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে।

৫, ৬. (ক) মূল ভাষার যে-শব্দগুলো ‘ন্যায়বিচার’ হিসেবে অনুবাদিত হয়েছে, সেগুলোর অর্থ কী? (খ) ঈশ্বর ন্যায়পরায়ণ এই কথার মানে কী?

বাইবেলে যে-মূল ভাষার শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো বিবেচনা করে যিহোবার ন্যায়বিচারের পরিধি ও গভীরতা আরও ভালভাবে বোঝা যেতে পারে। ইব্রীয় শাস্ত্রাবলিতে, তিনটে মূল শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যে-শব্দটাকে প্রায়ই ‘ন্যায়বিচার’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, সেটাকে “যা ন্যায্য” বলেও অনুবাদ করা যেতে পারে। (আদিপুস্তক ১৮:২৫, NW) অন্য দুটো শব্দ সাধারণত ‘ধার্ম্মিকতা’ হিসেবে অনুবাদিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় গ্রিক শাস্ত্রাবলিতে, ‘ধার্ম্মিকতা’ হিসেবে অনুবাদিত শব্দকে “ন্যায্য বা ন্যায়পরায়ণ হওয়ার গুণ” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অতএব, ধার্মিকতা ও ন্যায়বিচারের মধ্যে মূলত তেমন কোনো পার্থক্য নেই।—আমোষ ৫:২৪, NW.

তাই, বাইবেল যখন বলে যে ঈশ্বর ন্যায়পরায়ণ, তখন এটা আমাদের বলছে যে, যা কিছু ন্যায্য ও ন্যায়সংগত তিনি তা-ই করেন এবং তা তিনি সংগতিপূর্ণভাবে ও পক্ষপাতহীনভাবে করেন। (রোমীয় ২:১১, NW) তিনি এর চেয়ে ভিন্ন কিছু করবেন, তা ভাবাই যায় না। বিশ্বস্ত ইলীহূ বলেছিলেন: “ইহা দূরে থাকুক যে, ঈশ্বর দুষ্কার্য্য করিবেন, সর্ব্বশক্তিমান্‌ অন্যায় করিবেন।” (ইয়োব ৩৪:১০) বাস্তবিকই, যিহোবার পক্ষে ‘অন্যায় করা’ অসম্ভব। কেন? দুটো গুরুত্বপূর্ণ কারণে।

৭, ৮. (ক) কেন যিহোবা অন্যায় কাজ করতে অক্ষম? (খ) কী যিহোবাকে তাঁর আচরণে ধার্মিক বা ন্যায়পরায়ণ হতে পরিচালিত করে?

প্রথমত, তিনি পবিত্র। আমরা যেমন ৩য় অধ্যায়ে লক্ষ করেছি যে, যিহোবা চির বিশুদ্ধ ও ন্যায়নিষ্ঠ। তাই, তিনি অন্যায় কাজ করতে অক্ষম। এর মানে কী, তা বিবেচনা করুন। আমাদের স্বর্গীয় পিতার পবিত্রতা, এই বিষয়ে নির্ভর রাখতে জোরালো কারণ জোগায় যে, তিনি তাঁর সন্তানদের সঙ্গে কখনোই খারাপ ব্যবহার করবেন না। যিশুর এইরকম দৃঢ় আস্থা ছিল। তাঁর পার্থিব জীবনের শেষ রাতে, তিনি প্রার্থনা করেছিলেন: “পবিত্র পিতঃ, তোমার নামে তাহাদিগকে [শিষ্যদের] রক্ষা কর।” (যোহন ১৭:১১) “পবিত্র পিতঃ”—শাস্ত্রে, এইরকম সম্বোধন শুধু যিহোবার বেলায় প্রয়োগ হয়। এটা উপযুক্ত, কারণ পবিত্রতার ক্ষেত্রে কোনো মানব পিতাকেই তাঁর সঙ্গে তুলনা করা চলে না। যিশুর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, তাঁর শিষ্যরা পিতার সুরক্ষিত যত্নের অধীনে নিরাপদ থাকবে, যিনি পুরোপুরি বিশুদ্ধ ও শুচি এবং সমস্ত পাপ থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক।—মথি ২৩:৯.

দ্বিতীয়ত, নিঃস্বার্থ প্রেম ঈশ্বরের সত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। এইরকম প্রেম অন্যদের সঙ্গে তাঁর আচরণে তাঁকে ধার্মিক অথবা ন্যায়পরায়ণ হতে পরিচালিত করে। কিন্তু বিভিন্ন রকমের অবিচার—যেগুলোর অন্তর্ভুক্ত বর্ণবাদ, বৈষম্য এবং পক্ষপাত—প্রায়ই লোভ ও স্বার্থপরতা থেকে উদ্ভূত হয়, যা প্রেমের বিপরীত। প্রেমের ঈশ্বর সম্বন্ধে বাইবেল আমাদের আশ্বাস দেয়: “সদাপ্রভু ধর্ম্মময়, ধর্ম্মকর্ম্মই ভালবাসেন।” (গীতসংহিতা ১১:৭) যিহোবা নিজের সম্বন্ধে বলেন: “আমি সদাপ্রভু ন্যায়বিচার ভালবাসি।” (যিশাইয় ৬১:৮) এটা জানা কি সান্ত্বনাদায়ক নয় যে, যা ন্যায্য অথবা ন্যায় আমাদের ঈশ্বর তা করে আনন্দিত হন?—যিরমিয় ৯:২৪, NW.

করুণা এবং যিহোবার নিখুঁত ন্যায়বিচার

৯-১১. (ক) যিহোবার ন্যায়বিচার ও তাঁর করুণার মধ্যে কোন সম্পর্ক রয়েছে? (খ) যিহোবা পাপী মানুষদের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করেন তাতে তাঁর ন্যায়বিচার ও সেইসঙ্গে করুণা কীভাবে স্পষ্ট দেখা যায়?

যিহোবার ন্যায়বিচার তাঁর অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের অন্য সমস্ত দিকের মতোই নিখুঁত, এতে কোনো কিছুর ঘাটতি নেই। যিহোবার উচ্চ প্রশংসা করে মোশি লিখেছিলেন: “তিনি শৈল, তাঁহার কর্ম্ম সিদ্ধ, কেননা তাঁহার সমস্ত পথ ন্যায্য; তিনি বিশ্বাস্য ঈশ্বর, তাঁহাতে অন্যায় নাই; তিনিই ধর্ম্মময় ও সরল।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৩, ৪) যিহোবার ন্যায়বিচারের প্রতিটা অভিব্যক্তি নিখুঁত—কখনোই খুব বেশি কোমল নয় আবার খুব বেশি কঠোরও নয়।

১০ যিহোবার ন্যায়বিচার ও তাঁর করুণার মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। গীতসংহিতা ১১৬:৫ পদ বলে: “সদাপ্রভু কৃপাবান ও ধর্ম্মময় [“ন্যায়পরায়ণ,” দ্যা নিউ অ্যামেরিকান বাইবেল], বস্তুতঃ আমাদের ঈশ্বর স্নেহশীল [“করুণা দেখান,” NW]।” হ্যাঁ, যিহোবা ন্যায়পরায়ণ ও করুণাময় উভয়ই। এই দুটো বৈশিষ্ট্য পরস্পরবিরোধী নয়। তাঁর করুণা অনুশীলন করা মানে তাঁর ন্যায়বিচারকে হালকা করে দেওয়া নয়, যেন তা না হলে তাঁর ন্যায়বিচার খুবই কঠোর হতো। এর বিপরীতে, তিনি প্রায়ই এই গুণ দুটো একই সময়ে এমনকি একই কাজে প্রকাশ করেন। একটা উদাহরণ বিবেচনা করুন

১১ সমস্ত মানুষ উত্তরাধিকারসূত্রে পাপী আর এর ফলে পাপের শাস্তি—মৃত্যু—পাওয়ার যোগ্য। (রোমীয় ৫:১২) কিন্তু যিহোবা পাপীদের মৃত্যুতে খুশি হন না। তিনি “ক্ষমাবান্‌ ঈশ্বর, কৃপাময় ও স্নেহশীল [“করুণাময়,” NW]।” (নহিমিয় ৯:১৭) তারপরও, তিনি যেহেতু পবিত্র, তাই অধার্মিকতাকে উপেক্ষা করতে পারেন না। তা হলে, কীভাবে তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পাপী মানুষদের প্রতি করুণা দেখাবেন? এই উত্তর ঈশ্বরের বাক্যের মূল্যবান সত্যগুলোর একটাতে পাওয়া যায়: মানবজাতির পরিত্রাণের জন্য যিহোবার এক মুক্তির মূল্যের ব্যবস্থা। ১৪ অধ্যায়ে আমরা এই প্রেমময় ব্যবস্থা সম্বন্ধে আরও বেশি জানতে পারব। একই সময়ে এটা পুরোপুরি ন্যায্য ও পরম করুণাপূর্ণ। এর মাধ্যমে যিহোবা তাঁর নিখুঁত ন্যায়বিচারের মানগুলো বজায় রেখে অনুতপ্ত পাপীদের প্রতি কোমল করুণা দেখাতে পারেন।—রোমীয় ৩:২১-২৬.

যিহোবার ন্যায়বিচার হৃদয়গ্রাহী

১২, ১৩. (ক) যিহোবার ন্যায়বিচার কেন আমাদের তাঁর নিকটবর্তী করে? (খ) দায়ূদ যিহোবার ন্যায়বিচার সম্বন্ধে কোন উপসংহারে পৌঁছেছিলেন এবং এটা কীভাবে আমাদের সান্ত্বনা দিতে পারে?

১২ যিহোবার ন্যায়বিচার অনুভূতিহীন কোনো গুণ নয়, যা আমাদের দূরে ঠেলে দেয় বরং এটা এক প্রীতিকর গুণ, যা আমাদের তাঁর নিকটবর্তী করে। বাইবেল যিহোবার ন্যায়বিচার বা ধার্মিকতার সমবেদনাপূর্ণ প্রকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে। আসুন আমরা কিছু হৃদয়গ্রাহী উপায় বিবেচনা করি, যেখানে যিহোবা তাঁর ন্যায়বিচার অনুশীলন করেন।

১৩ যিহোবার নিখুঁত ন্যায়বিচার তাঁকে তাঁর দাসদের প্রতি বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য দেখাতে পরিচালিত করে। গীতরচক দায়ূদ যিহোবার ন্যায়বিচারের এই দিকটা সরাসরি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তার নিজের অভিজ্ঞতা ও ঈশ্বর যেভাবে কাজ করেন, তা নিজে পর্যবেক্ষণ করে, দায়ূদ কোন উপসংহারে পৌঁছেছিলেন? তিনি ঘোষণা করেছিলেন: “সদাপ্রভু ন্যায়বিচার ভালবাসেন; তিনি আপন সাধুগণকে [“অনুগত ব্যক্তিদের,” NW] পরিত্যাগ করেন না; তাহারা চিরকাল রক্ষিত হয়।” (গীতসংহিতা ৩৭:২৮) কতই না সান্ত্বনাদায়ক আশ্বাস! আমাদের ঈশ্বর একমুহূর্তের জন্যও তাদের পরিত্যাগ করবেন না, যারা তাঁর প্রতি অনুগত। অতএব আমরা তাঁর সঙ্গে আমাদের নিকট সম্পর্ক ও তাঁর প্রেমময় যত্নের ওপর নির্ভর করতে পারি। তাঁর ন্যায়বিচার এই নিশ্চয়তা দেয়!—হিতোপদেশ ২:৭, ৮.

১৪. যিহোবা ইস্রায়েলীয়দের যে-ব্যবস্থা দিয়েছিলেন, তাতে অভাবীদের জন্য তাঁর কোন চিন্তা স্পষ্ট দেখা যায়?

১৪ ঐশিক ন্যায়বিচার দুর্দশাগ্রস্তদের চাহিদাগুলো সম্বন্ধে সচেতন। অভাবীদের জন্য যিহোবা যে চিন্তা করেন, সেটার প্রমাণ তিনি ইস্রায়েলীয়দের যে-ব্যবস্থা দিয়েছিলেন তাতে স্পষ্ট হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনাথ ও বিধবাদের যাতে যত্ন নেওয়া হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থায় বিশেষ শর্তগুলো ছিল। (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১৭-২১) এই পরিবারগুলোর জীবন কতটা কষ্টকর হবে তা উপলব্ধি করে, যিহোবা নিজে তাদের পিতৃতুল্য বিচারক ও রক্ষাকর্তা হয়েছিলেন, যিনি “পিতৃহীনের ও বিধবার বিচার নিষ্পন্ন করেন।” (দ্বিতীয় বিবরণ ১০:১৮; গীতসংহিতা ৬৮:৫) যিহোবা ইস্রায়েলীয়দের সর্তক করেছিলেন যে, তারা যদি অসহায় নারী ও বাচ্চাদের নিপীড়ন করে, তা হলে তিনি এদের কান্না অবশ্যই শুনবেন। তিনি বলেছিলেন: “আমার ক্রোধ প্রজ্বলিত হইবে।” (যাত্রাপুস্তক ২২:২২-২৪) ক্রোধ যিহোবার একটা মুখ্য গুণ না হলেও, ইচ্ছাকৃতভাবে করা অবিচারের জন্য, বিশেষ করে দরিদ্র ও অসহায়রা নিপীড়িত হলে, তাঁর মধ্যে ধার্মিক ক্ষোভ জেগে ওঠে।—গীতসংহিতা ১০৩:৬.

১৫, ১৬. যিহোবার পক্ষপাতহীনতার প্রকৃত উল্লেখযোগ্য প্রমাণ কী?

১৫ এ ছাড়া, যিহোবা আমাদের আশ্বাস দেন যে তিনি “কাহারও মুখাপেক্ষা [“পক্ষপাতিত্ব,” NW] করেন না, ও উৎকোচ গ্রহণ করেন না।” (দ্বিতীয় বিবরণ ১০:১৭) ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালী অনেক মানুষের বৈসাদৃশ্যে, যিহোবা বস্তুগত ধনসম্পদ বা বাহ্যিক চেহারার দ্বারা প্রভাবিত হন না। তিনি বিশেষ দুর্বলতা দেখানো বা পক্ষানুরাগ থেকে একেবারেই মুক্ত। যিহোবার পক্ষপাতহীনতার এক প্রকৃত উল্লেখযোগ্য প্রমাণ বিবেচনা করুন। অনন্তজীবনের আশা নিয়ে তাঁর সত্য উপাসক হওয়ার সুযোগ, শুধু সমাজের উচ্চশ্রেণীর কিছু লোকেদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং, “প্রত্যেক জাতির মধ্যে যে কেহ তাঁহাকে ভয় করে ও ধর্ম্মাচরণ করে, সে তাঁহার গ্রাহ্য হয়।” (প্রেরিত ১০:৩৪, ৩৫) এই চমৎকার প্রত্যাশা সকলের জন্য রয়েছে, তা তাদের সামাজিক অবস্থান, চামড়ার রং যাই হোক না কেন কিংবা যে-দেশেই তারা বাস করুক না কেন। এটাই কি সর্বোৎকৃষ্ট প্রকৃত ন্যায়বিচার নয়?

১৬ যিহোবার নিখুঁত ন্যায়বিচারের আরেকটা দিক রয়েছে যা আমাদের বিবেচনা ও সম্মানের যোগ্য: তাঁর ধার্মিক মান লঙ্ঘনকারীদের সঙ্গে তিনি যেভাবে আচরণ করেন।

শাস্তি থেকে রেহাই নেই

১৭. ব্যাখ্যা করুন যে, কেন এই জগতের অবিচারগুলো যিহোবার ন্যায়বিচারের সত্যতাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করে না।

১৭ কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারে: ‘যিহোবা যেহেতু অধার্মিকতাকে উপেক্ষা করেন না, তা হলে আজকের জগতে অহরহ ঘটে চলা অন্যায্য কষ্টভোগ এবং খারাপ অভ্যাসগুলোর বিষয়টাকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি?’ এইরকম অবিচারগুলো কোনোভাবেই যিহোবার ন্যায়বিচারের সত্যতাকে অস্বীকার করে না। এই দুষ্ট জগতের বহু অবিচারই পাপের পরিণতি, যা মানুষেরা উত্তরাধিকারসূত্রে আদমের কাছ থেকে পেয়েছে। এমন এক জগৎ যেখানে অসিদ্ধ মানুষেরা তাদের পাপের পথ বেছে নিয়েছে, সেখানে অবিচার একেবারে ছেয়ে গেছে—কিন্তু বেশি দিনের জন্য নয়।—দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৫.

১৮, ১৯. কী দেখায় যে যিহোবা সেই ব্যক্তিদের চিরদিন সহ্য করবেন না, যারা স্বেচ্ছায় তাঁর ধার্মিক আইনগুলো লঙ্ঘন করে?

১৮ যারা অকপটতার সঙ্গে তাঁর নিকটবর্তী হয় তাদের প্রতি যদিও যিহোবা প্রচুর করুণা দেখান কিন্তু তিনি সেই পরিস্থিতি চিরদিন সহ্য করবেন না, যা তাঁর পবিত্র নামের ওপর কলঙ্ক নিয়ে আসে। (গীতসংহিতা ৭৪:১০, ২২, ২৩) ন্যায়বিচারক ঈশ্বরকে উপহাস করা যায় না; তিনি স্বেচ্ছাচারী পাপীদের তাদের আচরণের উপযুক্ত কঠোর বিচার থেকে রক্ষা করবেন না। যিহোবা হলেন, “করুণাময় ও সদয় ঈশ্বর, ক্রোধে ধীর এবং প্রেমপূর্ণ-দয়া ও সত্যে মহান; . . . কিন্তু তিনি কোনভাবেই শাস্তি থেকে রেহাই দেবেন না।” (যাত্রাপুস্তক ৩৪:৬, ৭, NW) এই বাক্যগুলোর সঙ্গে মিল রেখে, যিহোবা মাঝে মাঝে সেই ব্যক্তিদের বিচার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন, যারা স্বেচ্ছায় তাঁর ধার্মিক আইনগুলো লঙ্ঘন করে।

১৯ উদাহরণ হিসেবে, প্রাচীন ইস্রায়েলের সঙ্গে ঈশ্বরের আচরণ বিবেচনা করুন। এমনকি প্রতিজ্ঞাত দেশে বাস করার সময়ও, ইস্রায়েলীয়রা বার বার অবিশ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। যদিও তাদের কলুষিত জীবনযাত্রা যিহোবাকে “মনঃপীড়া” দিয়েছিল, তবুও তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরিত্যাগ করেননি। (গীতসংহিতা ৭৮:৩৮-৪১) বরং, তিনি করুণার সঙ্গে তাদের জীবনধারা পরিবর্তন করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তিনি মিনতি জানিয়েছিলেন: “দুষ্ট লোকের মরণে আমার সন্তোষ নাই; বরং দুষ্ট লোক যে আপন পথ হইতে ফিরিয়া বাঁচে, [ইহাতেই আমার সন্তোষ]। তোমরা ফির, আপন আপন কুপথ হইতে ফির; কারণ, হে ইস্রায়েল-কুল, তোমরা কেন মরিবে?” (যিহিষ্কেল ৩৩:১১) জীবনকে মূল্যবান হিসেবে দেখেন বলে যিহোবা বার বার তাঁর ভাববাদীদের পাঠিয়েছিলেন, যাতে ইস্রায়েলীয়রা তাদের খারাপ জীবনধারা থেকে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু, সামগ্রিকভাবে, এই কঠিন হৃদয়ের লোকেরা শোনেনি ও অনুতপ্ত হয়নি। শেষ পর্যন্ত, যিহোবা তাঁর পবিত্র নাম এবং এটা যা প্রতিনিধিত্ব করে সেটার জন্য তাদেরকে শত্রুদের হাতে সমর্পণ করেছিলেন।—নহিমিয় ৯:২৬-৩০.

২০. (ক) ইস্রায়েলের সঙ্গে যিহোবার আচরণ তাঁর সম্বন্ধে আমাদের কী শেখায়? (খ) কেন সিংহ যিহোবার ন্যায়বিচারের উপযুক্ত প্রতীক?

২০ ইস্রায়েলের সঙ্গে যিহোবার আচরণ তাঁর সম্বন্ধে আমাদের অনেক কিছু শেখায়। আমরা জানি যে, তাঁর সর্বদর্শী চোখ অধার্মিকতা লক্ষ করে এবং তিনি যা দেখতে পান সেটার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। (হিতোপদেশ ১৫:৩) এটা জানাও আশ্বাসদায়ক যে তিনি করুণা দেখানোর উপায় খোঁজেন, যদি তা দেখানোর ভিত্তি থাকে। এ ছাড়া, আমরা এও শিখেছি যে তাঁর ন্যায়বিচার কখনোই তাড়াহুড়ো করে করা হয় না। যিহোবার ধৈর্য ও দীর্ঘসহিষ্ণুতার জন্য, অনেক লোক ভুলভাবে এই সিদ্ধান্তে আসে যে, তিনি দুষ্টদের কখনোই বিচার করবেন না। কিন্তু তা একেবারেই সত্য নয় কারণ ইস্রায়েলের সঙ্গে ঈশ্বরের আচরণ আমাদের এও শেখায় যে, ঐশিক ধৈর্যেরও সীমা আছে। যিহোবা ধার্মিকতার ক্ষেত্রে দৃঢ়। ন্যায়বিচার করা থেকে প্রায়ই পিছু হটে আসে এমন মানুষদের বৈসাদৃশ্যে, তিনি যা ন্যায্য সেটার পক্ষে দাঁড়াতে কখনোই সাহস হারান না। উপযুক্তভাবেই, সাহসী ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে সিংহকে ঈশ্বরের উপস্থিতি ও সিংহাসনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। * (যিহিষ্কেল ১:১০; প্রকাশিত বাক্য ৪:৭) এভাবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, তিনি এই পৃথিবীকে অবিচার থেকে মুক্ত করার বিষয়ে তাঁর প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবেন। হ্যাঁ, তাঁর ন্যায়বিচারের প্রকৃতিকে সংক্ষেপে এভাবে বলা যেতে পারে: যেখানে প্রয়োজন সেখানে দৃঢ়তা আর যেখানে সম্ভব সেখানে করুণা।—২ পিতর ৩:৯.

ন্যায়বিচারক ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়া

২১. যিহোবা যেভাবে ন্যায়বিচার অনুশীলন করেন, তা নিয়ে যখন আমরা ধ্যান করি, তখন তাঁর সম্বন্ধে আমাদের কীরকম চিন্তা করা উচিত এবং কেন?

২১ যিহোবা যেভাবে ন্যায়বিচার অনুশীলন করেন সেই সম্বন্ধে আমরা যখন ধ্যান করি, তখন আমাদের তাঁকে একজন আবেগহীন, কঠোর বিচারক হিসেবে চিন্তা করা উচিত নয়, যিনি কেবল অন্যায়কারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য চিন্তিত। এর পরিবর্তে, তাঁকে আমাদের এক প্রেমময় অথচ দৃঢ় পিতা হিসেবে মনে করা উচিত, যিনি সবসময় তাঁর সন্তানদের সঙ্গে সর্বোত্তমভাবে আচরণ করেন। একজন ন্যায়পরায়ণ বা ধার্মিক পিতা হিসেবে, যিহোবা তাঁর পার্থিব সন্তানদের প্রতি—যাদের তাঁর সাহায্যের ও ক্ষমার প্রয়োজন রয়েছে—যা সঠিক তা করার জন্য দৃঢ়তা ও কোমল সমবেদনার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখেন।—গীতসংহিতা ১০৩:১০, ১৩.

২২. ন্যায়বিচারের দ্বারা পরিচালিত হয়ে, যিহোবা আমাদের জন্য কোন প্রত্যাশা সম্ভবপর করেছেন আর কেন যিহোবা আমাদের সঙ্গে এইরকম আচরণ করেন?

২২ আমরা কতই না কৃতজ্ঞ হতে পারি যে ঐশিক ন্যায়বিচারের মধ্যে শুধু অন্যায়কারীদের শাস্তি দেওয়ার চেয়েও আরও বেশি কিছু জড়িত! ন্যায়বিচারের দ্বারা পরিচালিত হয়ে, যিহোবা আমাদের জন্য প্রকৃতই এক রোমাঞ্চকর প্রত্যাশা—“ধার্ম্মিকতা বসতি করে” এমন এক জগতে সিদ্ধ, অন্তহীন জীবন—সম্ভবপর করেছেন। (২ পিতর ৩:১৩) আমাদের ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে এইরকম আচরণ করেন কারণ তাঁর ন্যায়বিচার দোষারোপ করার চেয়ে বরং রক্ষা করার উপায়গুলো খোঁজে। সত্যিই, যিহোবার ন্যায়বিচারের পরিধি আরও ভালভাবে বোঝা আমাদের তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে! পরের অধ্যায়গুলোতে আমরা আরও ভাল করে দেখব যে, কীভাবে যিহোবা এই উত্তম গুণটি প্রকাশ করেন।

^ অনু. 20 আগ্রহের বিষয় যে, অবিশ্বস্ত ইস্রায়েলের বিচার করার সময় যিহোবা নিজেকে একটা সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন।—যিরমিয় ২৫:৩৮; হোশেয় ৫:১৪.