অধ্যায় ২৯
‘খ্রীষ্টের প্রেম জানিতে সমর্থ হওয়া’
১-৩. (ক) কী যিশুকে তাঁর পিতার মতো হতে চাইতে পরিচালিত করেছিল? (খ) যিশুর প্রেমের কোন বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা পরীক্ষা করব?
আপনি কি কখনও একটা বাচ্চা ছেলেকে তার বাবার মতো হওয়ার চেষ্টা করতে দেখেছেন? ছেলেটা হয়তো তার বাবা যেভাবে হাঁটে, কথা বলে বা কাজ করে, তা অনুকরণ করার চেষ্টা করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সেই ছেলে হয়তো তার বাবার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণগুলো অর্জন করতে পারে। হ্যাঁ, একটা ছেলে প্রেমময় বাবার প্রতি যে-ভালবাসা ও শ্রদ্ধা বোধ করে, তা তাকে তার বাবার মতো হতে চাইতে পরিচালিত করে।
২ যিশু ও তাঁর স্বর্গীয় পিতার মধ্যে যে-সম্পর্ক রয়েছে, সেই সম্বন্ধে কী বলা যায়? একবার যিশু বলেছিলেন, “আমি পিতাকে প্রেম করি।” (যোহন ১৪:৩১) এই পুত্র, যিনি অন্য সমস্ত প্রাণী সৃষ্ট হওয়ার অনেক আগে থেকে পিতার সঙ্গে ছিলেন, তাঁর চেয়ে সম্ভবত আর কেউই যিহোবাকে বেশি ভালবাসতে পারে না। সেই প্রেম এই অনুগত পুত্রকে তাঁর পিতার মতো হতে চাইতে পরিচালিত করেছিল।—যোহন ১৪:৯.
৩ এই বইয়ের আগের অধ্যায়গুলোতে, যিশু যেভাবে যিহোবার শক্তি, ন্যায়বিচার ও প্রজ্ঞাকে নিখুঁতভাবে অনুকরণ করেছিলেন, সেই বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। কিন্তু, কীভাবে যিশু তাঁর পিতার প্রেমকে প্রতিফলিত করেছিলেন? আসুন আমরা যিশুর প্রেমের তিনটে বৈশিষ্ট্য—তাঁর আত্মত্যাগমূলক মনোভাব, কোমল সমবেদনা এবং তাঁর ক্ষমা করার ইচ্ছা—পরীক্ষা করে দেখি।
“ইহা অপেক্ষা অধিক প্রেম কাহারও নাই”
৪. মানুষের মধ্যে কীভাবে যিশু আত্মত্যাগমূলক প্রেমের সবচেয়ে বড় উদাহরণ স্থাপন করেন?
৪ যিশু আত্মত্যাগমূলক প্রেমের এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ স্থাপন করেন। আত্মত্যাগের সঙ্গে নিঃস্বার্থভাবে অন্যের চাহিদা ও আগ্রহগুলোকে নিজেদের চেয়ে আগে রাখা জড়িত। কীভাবে যিশু এইরকম প্রেম প্রদর্শন করেছিলেন? তিনি নিজে ব্যাখ্যা করেছিলেন: “কেহ যে আপন বন্ধুদের নিমিত্ত নিজ প্রাণ সমর্পণ করে, ইহা অপেক্ষা অধিক প্রেম কাহারও নাই।” (যোহন ১৫:১৩) যিশু স্বেচ্ছায় তাঁর সিদ্ধ জীবন আমাদের জন্য দিয়েছিলেন। এটা ছিল কোনো মানুষের দ্বারা কৃত প্রেমের সবচেয়ে মহৎ প্রকাশ। কিন্তু সেইসঙ্গে যিশু অন্যভাবেও আত্মত্যাগমূলক প্রেম প্রদর্শন করেছিলেন।
৫. কেন স্বর্গ ত্যাগ করা ঈশ্বরের একজাত পুত্রের জন্য এক প্রেমময় আত্মত্যাগ ছিল?
৫ ঈশ্বরের একজাত পুত্রের মনুষ্যপূর্ব অস্তিত্বের সময়, স্বর্গে এক অতুলনীয় ও উচ্চীকৃত অবস্থান ছিল। যিহোবার ও লক্ষ লক্ষ আত্মিক প্রাণীর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ মেলামেশা ছিল। ব্যক্তিগত এই সুযোগগুলো থাকা সত্ত্বেও, এই প্রিয় পুত্র “আপনাকে শূন্য করিলেন, দাসের রূপ ধারণ করিলেন, মনুষ্যদের সাদৃশ্যে জন্মিলেন।” (ফিলিপীয় ২:৭) তিনি স্বেচ্ছায় এমন এক জগতে পাপী মানুষের সঙ্গে থাকতে এসেছিলেন, যা “পাপাত্মার মধ্যে শুইয়া রহিয়াছে।” (১ যোহন ৫:১৯) সেটা কি ঈশ্বরের পুত্রের জন্য এক প্রেমময় আত্মত্যাগ ছিল না?
৬, ৭. (ক) যিশু তাঁর পার্থিব পরিচর্যার সময়ে কীভাবে আত্মত্যাগমূলক প্রেম দেখিয়েছিলেন? (খ) যোহন ১৯:২৫-২৭ পদে নিঃস্বার্থ প্রেমের কোন মর্মস্পর্শী উদাহরণ লিপিবদ্ধ আছে?
৬ যিশু তাঁর পার্থিব পরিচর্যা জুড়ে বিভিন্নভাবে আত্মত্যাগমূলক প্রেম দেখিয়েছিলেন। তিনি সম্পূর্ণভাবে নিঃস্বার্থ ছিলেন। তিনি তাঁর পরিচর্যায় এত বেশি নিবিষ্ট ছিলেন যে, মানুষেরা যে-সাধারণ আরামআয়েশে অভ্যস্ত, সেগুলোকে তিনি ত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “শৃগালদের গর্ত্ত আছে, এবং আকাশের পক্ষিগণের বাসা আছে; কিন্তু মনুষ্যপুত্ত্রের মস্তক রাখিবার স্থান নাই।” (মথি ৮:২০) একজন দক্ষ সূত্রধর হওয়ায়, যিশু কিছুটা সময় নিয়ে নিজের জন্য একটা আরামদায়ক বাড়ি বানাতে পারতেন বা সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র বানাতে পারতেন, যা বিক্রি করে তিনি কিছু অতিরিক্ত টাকা আয় করতে পারতেন। কিন্তু, তিনি তাঁর দক্ষতাকে বস্তুগত জিনিস পাওয়ার জন্য ব্যবহার করেননি।
৭ যিশুর আত্মত্যাগমূলক প্রেমের এক প্রকৃত মর্মস্পর্শী উদাহরণ যোহন ১৯:২৫-২৭ পদে লিপিবদ্ধ আছে। যেদিন তিনি মারা গিয়েছিলেন, সেদিন বিকেলে যিশুর মন ও হৃদয় জুড়ে যে-বিষয়গুলো ছিল, তা চিন্তা করুন। কাষ্ঠদণ্ডে যাতনা ভোগ করার সময়, তিনি তাঁর শিষ্যদের সম্বন্ধে, প্রচার কাজ এবং বিশেষ করে তাঁর নীতিনিষ্ঠা ও কীভাবে তা তাঁর পিতার নামের ওপর প্রভাব ফেলবে, সেই সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন ছিলেন। সত্যিই, মানবজাতির পুরো ভবিষ্যৎ তাঁর ওপর নির্ভর করছিল! কিন্তু, তিনি মারা যাওয়ার মাত্র কিছুক্ষণ আগে, যিশু তাঁর মা মরিয়ম যিনি স্পষ্টতই তখন বিধবা ছিলেন, তার জন্যও চিন্তা দেখিয়েছিলেন। যিশু প্রেরিত যোহনকে তার নিজের মায়ের মতো করে মরিয়মের যত্ন নিতে বলেছিলেন আর সেই কথা অনুযায়ী মরিয়মকে প্রেরিত তার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। যিশু এভাবে তাঁর মায়ের শারীরিক ও আধ্যাত্মিক যত্নের ব্যবস্থা করেছিলেন। নিঃস্বার্থ প্রেমের কী এক কোমল প্রকাশ!
‘যিশু মমতা বোধ করলেন’
৮. বাইবেল যিশুর সমবেদনাকে বর্ণনা করার জন্য যে-গ্রিক শব্দ ব্যবহার করে, সেটার অর্থ কী?
৮ যিশু তাঁর পিতার মতো সমব্যথী ছিলেন। শাস্ত্র যিশুকে এমন একজন হিসেবে বর্ণনা করে, যিনি দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন কারণ তা তাঁর হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। যিশুর সমবেদনা বর্ণনা করার জন্য বাইবেল একটা গ্রিক শব্দ ব্যবহার করে, যা ‘মমতা বোধ করা’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়। একজন পণ্ডিত ব্যক্তি বলেন: “এটা . . . এমন এক আবেগকে বর্ণনা করে, যা একজন ব্যক্তির গভীরতম অনুভূতিগুলোকে নাড়া দেয়। এটা সমবেদনার অনুভূতির জন্য গ্রিক ভাষার সবচেয়ে জোরালো শব্দ।” কিছু পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করুন, যেখানে যিশু গভীর সমবেদনার দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন, যা তাঁকে কাজ করতে চালিত করেছিল।
৯, ১০. (ক) কোন পরিস্থিতির কারণে যিশু ও তাঁর প্রেরিতরা এক নিরিবিলি স্থান খুঁজেছিলেন? (খ) যিশু যখন জনতার কারণে একান্তে সময় কাটাতে পারেননি, তখন কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন এবং কেন?
৯ আধ্যাত্মিক চাহিদাগুলোর প্রতি সাড়া দিতে পরিচালিত হয়েছিলেন। মার্ক ৬:৩০-৩৪ পদের ঘটনা দেখায় যে, কী যিশুকে মূলত তাঁর মমতা প্রকাশ করতে পরিচালিত করেছিল। সেই দৃশ্যটা কল্পনা করুন। প্রেরিতরা উত্তেজিত ছিলেন কারণ এইমাত্র তারা এক ব্যাপক প্রচার যাত্রা শেষ করেছেন। তারা যিশুর কাছে ফিরে এসেছিলেন এবং তারা যা দেখেছিলেন ও শুনেছিলেন, সেই সমস্তই অতি আগ্রহের সঙ্গে জানাচ্ছিলেন। কিন্তু, এক বিরাট জনতা একত্রিত হয়ে গিয়েছিল, যিশু ও তাঁর প্রেরিতদের এমনকি খাবারের সময়ও হয়নি। চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী মনোযোগী যিশু লক্ষ করেছিলেন যে, প্রেরিতরা ক্লান্ত। তিনি তাদের বলেছিলেন: “তোমরা বিরলে এক নির্জ্জন স্থানে আসিয়া কিছু কাল বিশ্রাম কর।” একটা নৌকায় চড়ে, তারা গালীল সাগরের ওপারে উত্তর প্রান্তের একটা নিরিবিলি জায়গার উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু জনতা তাদের যেতে দেখেছিল। অন্যেরাও এই বিষয়ে শুনেছিল। এরা সবাই উত্তর উপকূল ধরে হেঁটে নৌকার আগে অন্য পারে গিয়ে পৌঁছেছিল!
১০ একান্তে সময় কাটানো হয়নি বলে যিশু কি বিরক্ত হয়েছিলেন? অবশ্যই না! যোহন ৭:৪৭-৪৯) তিনি এই লোকেদের প্রতি মমতা বোধ করেছিলেন আর তাই তাদের “ঈশ্বরের রাজ্যের বিষয়” শিক্ষা দিতে শুরু করেছিলেন। (লূক ৯:১১) লক্ষ করুন যে, লোকেরা যিশুর শিক্ষার প্রতি কীভাবে সাড়া দেবে, তা দেখার আগেই তিনি তাদের প্রতি মমতা বোধ করেছিলেন। অন্য কথায়, জনতাকে শিক্ষা দেওয়ার ফল নয় বরং কোমল সমবেদনাই তা করার পিছনে তাঁর প্রেরণা ছিল।
হাজার হাজার লোকের এই জনতা, যারা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল তাদের দেখে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন। মার্ক লিখেছিলেন: “যিশু . . . বিস্তর লোক দেখিয়া তাহাদের প্রতি করুণাবিষ্ট হইলেন [“মমতা বোধ করলেন,” NW], কেননা তাহারা পালক-বিহীন মেষপালের ন্যায় ছিল; আর তিনি তাহাদিগকে অনেক বিষয় শিক্ষা দিতে লাগিলেন।” যিশু এই লোকেদের এমন ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, যাদের আধ্যাত্মিক চাহিদা রয়েছে। তারা অসহায়ভাবে ঘুরে বেড়ানো মেষের মতো, যাদের পরিচালনা বা রক্ষা করার জন্য কোনো পালক ছিল না। যিশু জানতেন যে পাষাণহৃদয়ের ধর্মীয় নেতারা, যাদের যত্নশীল পালক হওয়ার কথা ছিল, তারা সাধারণ লোকেদের উপেক্ষা করেছিল। (১১, ১২. (ক) বাইবেলের সময়ে কুষ্ঠরোগীদের কীভাবে দেখা হতো কিন্তু “সর্ব্বাঙ্গকুষ্ঠ” একজন ব্যক্তি যখন যিশুর নিকটবর্তী হয়েছিল, তখন তিনি কীভাবে সাড়া দিয়েছিলেন? (খ) যিশুর স্পর্শ কুষ্ঠরোগীকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং একজন চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা কীভাবে এটা বর্ণনা করে?
১১ কষ্ট দূর করতে পরিচালিত হয়েছিলেন। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত লোকেরা জানত যে, যিশুর সমবেদনা রয়েছে আর তাই তারা তাঁর নিকটবর্তী হয়েছিল। এটা বিশেষ করে সেই সময়ে স্পষ্ট হয়েছিল, যখন যিশুর পিছনে পিছনে আসা জনতার সঙ্গে এক “সর্ব্বাঙ্গকুষ্ঠ” ব্যক্তি তাঁর কাছে এসেছিল। (লূক ৫:১২) বাইবেলের সময়ে, কুষ্ঠরোগীদের আলাদা করে রাখা হতো, যাতে অন্যেরা সংক্রামিত হওয়া থেকে সুরক্ষিত থাকে। (গণনাপুস্তক ৫:১-৪) কিন্তু, পরে রব্বি নেতারা কুষ্ঠরোগ সম্বন্ধে এক নির্দয় দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিল ও তাদের নিজেদের তৈরি পীড়নকর নিয়মগুলো চাপিয়ে দিয়েছিল। * কিন্তু, কীভাবে যিশু কুষ্ঠরোগীর প্রতি সাড়া দিয়েছিলেন, তা লক্ষ করুন: “একদা এক জন কুষ্ঠী আসিয়া তাঁহার সম্মুখে বিনতি করিয়া ও জানু পাতিয়া কহিল, যদি আপনার ইচ্ছা হয়, আমাকে শুচি করিতে পারেন। তিনি করুণাবিষ্ট হইয়া [“মমতা বোধ করে,” NW] হাত বাড়াইয়া তাহাকে স্পর্শ করিলেন, কহিলেন, আমার ইচ্ছা, তুমি শুচীকৃত হও। তৎক্ষণাৎ কুষ্ঠরোগ তাহাকে ছাড়িয়া গেল।” (মার্ক ১:৪০-৪২) যিশু জানতেন যে, একজন কুষ্ঠরোগীর সেখানে আসাটাও আইনবিরুদ্ধ ছিল। তবুও, তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে যিশু এতটাই গভীরভাবে পরিচালিত হয়েছিলেন যে, তিনি অচিন্তনীয় কিছু করেছিলেন। যিশু তাকে স্পর্শ করেছিলেন!
১২ আপনি কি কল্পনা করতে পারেন যে, কুষ্ঠরোগীর জন্য সেই স্পর্শের মানে কী ছিল? উদাহরণস্বরূপ, একটা অভিজ্ঞতার কথা বিবেচনা করুন। কুষ্ঠরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পল ব্র্যান্ড একজন কুষ্ঠরোগী সম্বন্ধে বলেন, যার চিকিৎসা তিনি ভারতে করেছিলেন। পরীক্ষানিরীক্ষা করার সময়, চিকিৎসক তার হাত কুষ্ঠরোগীর কাঁধের ওপর রেখেছিলেন এবং একজন দোভাষীর মাধ্যমে চিকিৎসা পদ্ধতি সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যা সেই ব্যক্তির ওপর প্রয়োগ করা হবে। হঠাৎ করে, কুষ্ঠরোগী কাঁদতে শুরু করেছিলেন। চিকিৎসক জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমি কি ভুল কিছু বলেছি?” দোভাষী সেই যুবককে তার ভাষায় প্রশ্ন করেছিলেন এবং পরে উত্তর দিয়েছিলেন: “না ডাক্তার। তিনি বলছেন যে, আপনি আপনার হাত তার কাঁধে রেখেছেন বলে তিনি কাঁদছেন। এখানে আসার পর থেকে অনেক বছর ধরে কেউ তাকে স্পর্শ করেনি।” যে-কুষ্ঠরোগী যিশুর নিকটবর্তী হয়েছিল, তার কাছে যিশুর স্পর্শের আরও বেশি অর্থ ছিল। সেই একটা স্পর্শের পরে, যে-রোগ তাকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করেছিল, তা ভাল হয়ে গিয়েছিল!
১৩, ১৪. (ক) নায়িন্ নগরের নিকটে যিশু কোন যাত্রার সম্মুখীন হয়েছিলেন আর কী এটাকে খুবই দুঃখজনক পরিস্থিতি করে তুলেছিল? (খ) যিশুর সমবেদনা তাঁকে নায়িনের বিধবার জন্য কী করতে পরিচালিত করেছিল?
১৩ দুঃখ দূর করতে পরিচালিত হয়েছিলেন। যিশু অন্যদের দুঃখ দেখে গভীরভাবে প্রভাবিত হতেন। উদাহরণ হিসেবে, লূক ৭:১১-১৫ পদের বিবরণ বিবেচনা করুন। যিশু তাঁর পরিচর্যার মাঝামাঝি সময়ে যখন গালীলের নায়িন্ নগরের কাছাকাছি ছিলেন, তখন এটা ঘটেছিল। যিশু যখন সেই নগরের দ্বারের নিকটবর্তী হয়েছিলেন, তখন তিনি এক শবযাত্রার মুখোমুখি হয়েছিলেন। পরিস্থিতি খুবই দুঃখজনক ছিল। একজন যুবক যে একমাত্র সন্তান ছিল, সে মারা গিয়েছিল এবং তার মা একজন বিধবা ছিলেন। আরও একবার, সেই মহিলা হয়তো এইরকম এক যাত্রার সামিল হয়েছিলেন, যা ছিল তার স্বামীর শবযাত্রা। এবার ছিল তার ছেলের, যে হয়তো তার একমাত্র অবলম্বন ছিল। তার সঙ্গে যে-জনতা ছিল তাদের মধ্যে হয়তো বিলাপকারী ও বাদকগণ ছিল, যারা শোকপূর্ণ সংগীত বাজাচ্ছিল। (যিরমিয় ৯:১৭, ১৮; মথি ৯:২৩) কিন্তু, যিশুর দৃষ্টি শোকাহত মায়ের দিকে নিবদ্ধ ছিল, যিনি নিঃসন্দেহে তার ছেলের শবাধারের পাশে পাশে হাঁটছিলেন।
১৪ পুত্রবিয়োগে শোকার্ত মায়ের প্রতি যিশু “মমতা বোধ করলেন।” আশ্বাসের স্বরে তিনি তাকে বলেছিলেন: “কাঁদিও না।” তাঁকে ডাকা না হলেও তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং শবাধার স্পর্শ করেছিলেন। বাহকেরা—আর সম্ভবত জনতার বাকি লোকেরা—থেমে গিয়েছিল। ক্ষমতাসম্পন্ন স্বরে, যিশু মৃতদেহের সঙ্গে কথা বলেছিলেন: “হে যুবক, তোমাকে বলিতেছি, উঠ!” এরপর কী হয়েছিল? “সেই মরা মানুষটী উঠিয়া বসিল, এবং কথা কহিতে লাগিল,” যেন এক গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল! তারপর এক মর্মস্পর্শী উক্তি রয়েছে: “পরে, [যিশু] তাহাকে তাহার মাতার হস্তে সমর্পণ করিলেন।”
১৫. (ক) যিশুর মমতা বোধ করা সম্বন্ধে বাইবেলের বিবরণগুলো সমবেদনা ও কর্মশক্তির প্রয়োগের মধ্যে কোন সম্পর্ক দেখায়? (খ) এই ক্ষেত্রে আমরা কীভাবে যিশুকে অনুকরণ করতে পারি?
১৫ এই বিবরণগুলো থেকে আমরা কী শিখি? প্রতিটা ক্ষেত্রে, সমবেদনা ও কর্মশক্তি প্রয়োগের মধ্যে যে-সম্পর্ক রয়েছে, তা লক্ষ করুন। যিশু অন্যদের অবস্থা দেখে সবসময় মমতা বোধ করতেন এবং তাদের প্রতি তাঁর সমবেদনা সবসময়ই তাঁকে কাজ করতে পরিচালিত করত। কীভাবে আমরা তাঁর উদাহরণ অনুসরণ করতে পারি? খ্রিস্টান হিসেবে, আমাদের সুসমাচার প্রচার করার ও শিষ্য তৈরি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মূলত, আমরা ঈশ্বরের প্রতি প্রেমের দ্বারা পরিচালিত হই। কিন্তু, আসুন আমরা এও মনে রাখি যে, এটা সমবেদনার একটা কাজ। আমাদের যদি লোকেদের প্রতি যিশুর মতো সহানুভূতি থাকে, তা হলে আমাদের হৃদয় তাদের সুসমাচার জানানোর জন্য যা করা দরকার সেগুলোর সমস্তই করতে আমাদের পরিচালিত করবে। মথি ২২:৩৭-৩৯) যে-সহবিশ্বাসীরা কষ্ট ও দুঃখ ভোগ করছে, তাদের প্রতি সমবেদনা দেখানো সম্বন্ধে কী বলা যায়? আমরা অলৌকিকভাবে শারীরিক কষ্ট দূর করতে বা মৃতদের জীবিত করতে পারি না। কিন্তু, আমরা আমাদের চিন্তা প্রকাশ করার বা উপযুক্ত প্রয়োজনীয় সাহায্য করার পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে সমবেদনাকে কর্মশক্তিতে পরিণত করতে পারি।—ইফিষীয় ৪:৩২.
(“পিতঃ ইহাদিগকে ক্ষমা কর”
১৬. যিশু এমনকি যখন যাতনাদণ্ডে ছিলেন, তখন তাঁর ক্ষমা করার ইচ্ছা কীভাবে স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল?
১৬ যিশু আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে তাঁর পিতার প্রেমকে নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত করেছিলেন—তিনি “ক্ষমা করার জন্য তৈরি” ছিলেন। (গীতসংহিতা ৮৬:৫, NW) এমনকি তিনি যখন যাতনাদণ্ডে ছিলেন, তখনও ক্ষমা করার এই ইচ্ছা স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল। এক লজ্জাজনক মৃত্যু ভোগ করতে বাধ্য হয়ে, হাতে ও পায়ে পেরেক বিদ্ধ অবস্থায় যিশু কী বলেছিলেন? তিনি কি যিহোবাকে ঘাতকদের শাস্তি দেওয়ার জন্য বলেছিলেন? এর ঠিক বিপরীতটা হয়েছিল, যিশুর শেষ কথাগুলোর মধ্যে একটা ছিল: “পিতঃ ইহাদিগকে ক্ষমা কর, কেননা ইহারা কি করিতেছে, তাহা জানে না।”—লূক ২৩:৩৪. *
১৭-১৯. কীভাবে যিশু দেখিয়েছিলেন যে, প্রেরিত পিতর তাঁকে তিন বার অস্বীকার করলেও তিনি তাকে ক্ষমা করেছিলেন?
১৭ প্রেরিত পিতরের সঙ্গে যিশুর আচরণ থেকে সম্ভবত তাঁর ক্ষমার আরও মর্মস্পর্শী উদাহরণ দেখা যেতে পারে। কোনো সন্দেহ নেই যে, পিতর যিশুকে খুবই ভালবাসতেন। ১৪ই নিশান, যিশুর জীবনের শেষ রাতে পিতর তাঁকে বলেছিলেন: “প্রভু, আপনার সঙ্গে আমি কারাগারে যাইতে এবং মরিতেও প্রস্তুত আছি।” তবুও, লূক ২২:৩৩, ৬১, ৬২.
মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে, পিতর এমনকি যিশুকে চেনেন বলে তিন বার অস্বীকার করেছিলেন! পিতর যখন তৃতীয় বার অস্বীকার করেন, তখন কী হয়েছিল সেই বিষয়ে বাইবেল আমাদের বলে: “প্রভু মুখ ফিরাইয়া পিতরের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন।” তার পাপ কতটা গুরুতর সেটা বুঝে মর্মাহত হয়ে পিতর “বাহিরে গিয়া অত্যন্ত রোদন” করেছিলেন। সেই দিনই পরে যিশু যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন প্রেরিত হয়তো মনে মনে চিন্তা করেছিলেন, ‘আমার প্রভু কি আমাকে ক্ষমা করেছেন?’—১৮ উত্তরের জন্য পিতরকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। যিশু ১৬ই নিশান সকালে পুনরুত্থিত হয়েছিলেন এবং স্পষ্টতই সেদিনই তিনি ব্যক্তিগতভাবে পিতরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। (লূক ২৪:৩৪; ১ করিন্থীয় ১৫:৪-৮) যিশু কেন সেই প্রেরিতের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন, যিনি দৃঢ়ভাবে তাঁকে অস্বীকার করেছিলেন? যিশু হয়তো অনুতপ্ত পিতরকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন যে, তার প্রভু এখনও তাকে ভালবাসেন ও মূল্যবান মনে করেন। কিন্তু, যিশু পিতরকে শুধু পুনরায় আশ্বাস দেওয়ার চেয়েও বেশি কিছু করেছিলেন।
১৯ কিছু সময় পরে, যিশু গালীল সাগরে শিষ্যদের দেখা দিয়েছিলেন। এই সময়, যিশু পিতরকে (যিনি তিন বার তাঁর প্রভুকে অস্বীকার করেছিলেন) তিন বার তাঁকে পিতর ভালবাসেন কি না, সেই সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলেন। তৃতীয় বারের পর, পিতর উত্তর দিয়েছিলেন: “প্রভু, আপনি সকলই জানেন; আপনি জ্ঞাত আছেন যে, আমি আপনাকে ভালবাসি।” বাস্তবিকই, যিশু যিনি হৃদয় পড়তে জানেন তিনি তাঁর প্রতি পিতরের ভালবাসা ও স্নেহ সম্বন্ধে পুরোপুরি জানতেন। তথাপি, যিশু পিতরকে তার ভালবাসার সত্যতা প্রমাণ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া, যিশু পিতরকে তাঁর “মেষগণকে” ‘চরানোর’ ও “পালন” করার দায়িত্বও দিয়েছিলেন। (যোহন ২১:১৫-১৭) আগে, পিতর প্রচার করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। (লূক ৫:১০) কিন্তু এখন, নির্ভরতার এক উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনে যিশু তাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ এক দায়িত্ব দিয়েছিলেন আর তা হল সেই সমস্ত ব্যক্তির যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব, যারা খ্রিস্টের অনুসারী হবে। এর অল্প কিছুদিন পরে, যিশু পিতরকে শিষ্যদের কাজে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দান করেছিলেন। (প্রেরিত ২:১-৪১) যিশু তাকে ক্ষমা করেছেন এবং এখনও তার ওপর তিনি নির্ভর করেন জেনে পিতর কতই না স্বস্তি বোধ করেছিলেন!
আপনি কি ‘খ্রীষ্টের প্রেম জানেন’?
২০, ২১. কীভাবে আমরা পুরোপুরিভাবে ‘খ্রীষ্টের প্রেম জানিতে সমর্থ হইতে’ পারি?
২০ সত্যিই, যিহোবার বাক্য খ্রিস্টের প্রেম সম্বন্ধে সুন্দরভাবে বর্ণনা করে। তা হলে, কীভাবে আমাদের যিশুর প্রেমের প্রতি সাড়া দেওয়া উচিত? বাইবেল আমাদের ‘জ্ঞানাতীত যে খ্রীস্টের প্রেম, তাহা জানিতে সমর্থ হওয়ার’ জন্য উৎসাহিত করে। (ইফিষীয় ৩:১৯) আমরা যেমন দেখেছি যে, যিশুর জীবন এবং পরিচর্যা সম্বন্ধে সুসমাচারের বিবরণ খ্রিস্টের প্রেম সম্বন্ধে আমাদের অনেক কিছু শেখায়। কিন্তু, “খ্রীষ্টের প্রেম” পুরোপুরিভাবে জানার সঙ্গে বাইবেল তাঁর সম্বন্ধে কী বলে, তা শেখার চেয়ে আরও বেশি কিছু জড়িত।
২১ যে-গ্রিক শব্দকে “জানিতে” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, সেটার অর্থ “ব্যবহারিকভাবে, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে” জানা। আমরা যখন যিশুর মতো প্রেম দেখাই—নিঃস্বার্থভাবে অন্যদের জন্য নিজেদের বিলিয়ে দিই, সমবেদনার সঙ্গে তাদের চাহিদাগুলোর প্রতি সাড়া দিই, হৃদয় থেকে তাদের ক্ষমা করি—তখন আমরা আসলেই তাঁর অনুভূতিগুলো বুঝতে পারি। এভাবে, আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ‘জ্ঞানাতীত যে খ্রীষ্টের প্রেম, তাহা জানিতে সমর্থ হই।’ আর আসুন আমরা যেন কখনোই ভুলে না যাই যে যতই আমরা খ্রিস্টের মতো হব, ততই আমরা আমাদের প্রেমময় ঈশ্বর যিহোবার নিকটবর্তী হব, যাঁকে যিশু নিখুঁতভাবে অনুকরণ করেছিলেন।
^ অনু. 11 রব্বিদের নিয়মগুলো উল্লেখ করেছিল যে, কারোরই একজন কুষ্ঠরোগীর চার কিউবিটের (প্রায় ১.৮ মিটার) মধ্যে আসা উচিত নয়। কিন্তু যদি বাতাস বইত, তা হলে কুষ্ঠরোগীর কাছ থেকে ১০০ কিউবিট (প্রায় ৪৫ মিটার) দূরে থাকতে হতো। মিডরেস রাব্বা একজন রব্বি সম্বন্ধে বলে, যিনি কুষ্ঠরোগীদের দেখে পালিয়ে যেতেন এবং আরেকজন সম্বন্ধে বলে যিনি কুষ্ঠরোগীদের দূরে রাখার জন্য তাদের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারতেন। তাই, কুষ্ঠরোগীরা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ব্যথা এবং ঘৃণিত ও অবাঞ্ছিত হওয়ার অনুভূতি সম্বন্ধে জানত।
^ অনু. 16 লূক ২৩:৩৪ পদের প্রথম অংশ কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, যেহেতু অন্য অনেক প্রামাণিক পাণ্ডুলিপিতে এই কথাগুলো পাওয়া যায়, তাই নতুন জগৎ অনুবাদ (ইংরেজি) এবং অসংখ্য অন্য অনুবাদের মধ্যে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যিশু স্পষ্টতই রোমীয় সৈন্যদের সম্বন্ধে বলছিলেন, যারা তাঁকে বিদ্ধ করেছিল। যিশু আসলে কে ছিলেন, সেই সম্বন্ধে অজ্ঞ হওয়ায় তারা কী করছে সেই বিষয়ে জানত না। কিন্তু, ধর্মীয় নেতারা যারা সেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছিল, তারা আরও বেশি দোষী ছিল কারণ তারা জেনেশুনে এবং বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে তা করেছিল। তাদের অনেককে কোনোভাবে ক্ষমা করা সম্ভব ছিল না।—যোহন ১১:৪৫-৫৩.