সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় পনেরো

আমাদের বয়স্ক বাবা-মাকে সমাদর করা

আমাদের বয়স্ক বাবা-মাকে সমাদর করা

১. বাবা-মায়ের কাছে আমাদের কোন ঋণ রয়েছে আর তাই তাদের প্রতি আমাদের কেমন বোধ করা এবং তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত?

 “তোমার জন্মদাতা পিতার কথা শুন, তোমার মাতা বৃদ্ধা হইলে তাঁহাকে তুচ্ছ করিও না,” বহুকাল আগের একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি পরামর্শ দিয়েছিলেন। (হিতোপদেশ ২৩:২২) ‘আমি কখনো তা করব না!’ আপনি হয়তো বলতে পারেন। আমাদের মধ্যে অধিকাংশই মাকে—অথবা বাবাকে—তুচ্ছ করার পরিবর্তে, তাদের প্রতি গভীর প্রেম অনুভব করি। আমরা স্বীকার করি যে, আমরা তাদের কাছে অনেক ঋণী। প্রথমত, আমাদের বাবা-মা আমাদের জীবন দান করেছেন। যদিও যিহোবা হলেন জীবনের উৎস, তবুও আমাদের বাবা-মা ছাড়া আমরা কখনোই অস্তিত্বে আসতে পারতাম না। আমরা বাবা-মাকে এমন কিছুই প্রদান করতে পারব না, যা জীবনের মতো এতটা মূল্যবান। এ ছাড়া, একটা সন্তানকে শিশুকাল থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সাহায্য করার সঙ্গে যে-আত্মত্যাগ, উদ্বিগ্নতাময় যত্ন, খরচ এবং প্রেমময় মনোযোগ যুক্ত থাকে, সেগুলোর কথা একটু চিন্তা করুন। তাই, এটা কতই না যুক্তিযুক্ত যে, ঈশ্বরের বাক্য পরামর্শ দেয়: “তোমার পিতাকে ও তোমার মাতাকে সমাদর করিও, . . . যেন তোমার মঙ্গল হয়, এবং তুমি দেশে দীর্ঘায়ু হও”!—ইফিষীয় ৬:২, ৩.

আবেগগত চাহিদাগুলো স্বীকার করা

২. কীভাবে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানরা তাদের বাবা-মায়ের “প্রত্যুপকার” করতে পারে?

প্রেরিত পৌল খ্রিস্টানদের লিখেছিলেন: “[পুত্ত্র কি পৌত্ত্রগণ] প্রথমতঃ নিজ বাটীর লোকদের প্রতি ভক্তি প্রকাশ করিতে ও পিতামাতার [“পিতামাতা ও পিতামহ, মাতামহের,” বাংলা ইজি-টু-রিড ভারসন] প্রত্যুপকার করিতে শিক্ষা করুক; কেননা তাহাই ঈশ্বরের সাক্ষাতে গ্রাহ্য।” (১ তীমথিয় ৫:৪) প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানরা, তাদের বাবা-মা ও ঠাকুরদাদা-ঠাকুরমা বা দাদু-দিদিমা তাদের পিছনে যে-প্রেমপূর্ণ, কর্মব্যস্তময় এবং যত্নশীল বছরগুলো ব্যয় করেছে, সেগুলোর জন্য উপলব্ধি দেখানোর মাধ্যমে এই “প্রত্যুপকার” করতে পারে। একটা যে-উপায়ে তারা উপলব্ধি দেখাতে পারে, তা হল এই বিষয়টা স্বীকার করার মাধ্যমে যে, প্রত্যেকের মতো বয়স্ক ব্যক্তিদেরও প্রেম ও আশ্বাসের প্রয়োজন রয়েছে—আর প্রায়ই খুব বেশি প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের সকলের মতো তাদেরও এইরকম বোধ করা প্রয়োজন যে, তাদেরকে মূল্যবান বলে গণ্য করা হয়। তাদেরও এইরকম অনুভব করা প্রয়োজন যে, তাদের জীবন মূল্যবান।

৩. কীভাবে আমরা বাবা-মা ও ঠাকুরদাদা-ঠাকুরমা বা দাদু-দিদিমাকে সমাদর করতে পারি?

তাই, আমরা আমাদের বাবা-মা এবং ঠাকুরদাদা-ঠাকুরমা বা দাদু-দিদিমাকে এই বিষয়টা বুঝতে দেওয়ার মাধ্যমে সমাদর করতে পারি যে, আমরা তাদেরকে ভালবাসি। (১ করিন্থীয় ১৬:১৪) আমাদের বাবা-মা যদি আমাদের সঙ্গে বাস না করে, তাহলে আমাদের মনে রাখা উচিত যে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা তাদের কাছে এক বিরাট অর্থ বহন করতে পারে। একটা উৎসাহজনক চিঠি, একটা টেলিফোন কল অথবা এক সাক্ষাৎ তাদের আনন্দকে বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখতে পারে। জাপানে বসবাসরত মিয়ো ৮২ বছর বয়সে লিখেছিলেন: “আমার মেয়ে [যার স্বামী একজন ভ্রমণ পরিচারক] আমাকে বলেছে: ‘মা, দয়া করে তুমিও আমাদের সঙ্গে “ভ্রমণ” করো।’ প্রতি সপ্তাহে সে আমাকে তাদের নির্ধারিত গন্তব্যের নাম ও টেলিফোন নম্বর পাঠায়। আমি আমার মানচিত্র খুলে বলতে পারি: ‘আচ্ছা, তারা এখন এখানে আছে!’ এইরকম এক সন্তান থাকার আশীর্বাদের জন্য আমি সবসময়ই যিহোবাকে ধন্যবাদ জানাই।”

বস্তুগত চাহিদাগুলো জুগিয়ে সাহায্য করা

৪. কীভাবে যিহুদি ধর্মীয় পরম্পরাগত বিধি বয়স্ক বাবা-মায়ের প্রতি নির্মম হতে উৎসাহিত করেছিল?

বাবা-মাকে সমাদর করার সঙ্গে কি তাদের বস্তুগত চাহিদাগুলোর যত্ন নেওয়াও যুক্ত থাকতে পারে? হ্যাঁ। বেশিরভাগ সময়ই তা থাকে। যিশুর দিনে যিহুদি ধর্মীয় নেতারা এইরকম পরম্পরাগত বিধি তুলে ধরেছিল যে, একজন ব্যক্তি যদি ঘোষণা দেয়, তার টাকাপয়সা অথবা সম্পত্তি “ঈশ্বরকে দত্ত হইয়াছে,” তাহলে তিনি বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়ার জন্য সেগুলো ব্যবহার করার দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পারেন। (মথি ১৫:৩-৬) কতই না নির্মম! বস্তুতপক্ষে, সেই ধর্মীয় নেতারা লোকেদেরকে নিজেদের বাবা-মাকে সমাদর করা নয় বরং তাদের চাহিদাগুলো স্বার্থপরভাবে অস্বীকার করার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ করতে উৎসাহিত করেছিল। আমরা কখনোই এমনটা করতে চাই না!—দ্বিতীয় বিবরণ ২৭:১৬.

৫. কিছু দেশে সরকারের দ্বারা জোগানো ভরণপোষণের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, কেন মাঝে মাঝে বাবা-মাকে সমাদর করার সঙ্গে আর্থিক সাহায্য প্রদান করা অন্তর্ভুক্ত?

আজকে অনেক দেশে, সরকার অনুমোদিত সামাজিক কার্যক্রমগুলো বয়স্ক ব্যক্তিদের কিছু বস্তুগত চাহিদা যেমন, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান এবং বয়স্ক ভাতা জুগিয়ে থাকে। অধিকন্তু, বয়স্ক ব্যক্তিরা নিজেরাও হয়তো তাদের বৃদ্ধ বয়সের জন্য কিছু সহায়সম্পদ আলাদা করে রাখতে পারে। কিন্তু, এই সহায়সম্পদ যদি শেষ হয়ে যায় অথবা অপর্যাপ্ত হয়, তাহলে সন্তানরা তাদের বাবা-মায়ের চাহিদাগুলো পূরণ করার জন্য যথাসাধ্য করার মাধ্যমে তাদেরকে সমাদর করে থাকে। বস্তুতপক্ষে, বয়স্ক বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়া হল, ঈশ্বরীয় ভক্তির অর্থাৎ পারিবারিক ব্যবস্থার উদ্যোক্তা যিহোবা ঈশ্বরের প্রতি একজন ব্যক্তির ভক্তির এক প্রমাণ।

প্রেম এবং আত্মত্যাগ

৬. বাবা-মায়ের চাহিদাগুলোর যত্ন নেওয়ার জন্য কেউ কেউ বসবাসের কোন ব্যবস্থা করেছে?

অনেক প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান প্রেম এবং আত্মত্যাগের মনোভাব নিয়ে বয়সের কারণে দুর্বল এমন বাবা-মায়ের চাহিদাগুলোর প্রতি সাড়া দিয়েছে। কেউ কেউ তাদের বাবা-মাকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে অথবা তাদের কাছাকাছি থাকার জন্য বাসস্থান পরিবর্তন করেছে। অন্যেরা বাসস্থান পরিবর্তন করে তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে বাস করেছে। বেশিরভাগ সময়ই, এই ধরনের ব্যবস্থা বাবা-মা ও সন্তান, উভয়ের জন্যই আশীর্বাদ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

৭. বয়স্ক বাবা-মায়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করে কাজ না করা কেন উত্তম?

তবে, মাঝে মাঝে এই ধরনের পরিবর্তন ভাল ফল নিয়ে আসে না। কেন? এর কারণ হয়তো খুব তাড়াহুড়ো করে অথবা কেবল আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়। “সতর্ক লোক নিজ পাদক্ষেপের প্রতি লক্ষ্য রাখে,” বাইবেল বিজ্ঞতার সঙ্গে সাবধান করে। (হিতোপদেশ ১৪:১৫) উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনার বয়স্ক মা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন আর আপনি মনে করেন যে, তিনি আপনার কাছে চলে আসলে তার জন্য হয়তো উপকারজনক হবে। সতর্কতার সঙ্গে আপনার পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করে আপনি হয়তো এই প্রশ্নগুলো বিবেচনা করতে পারেন: তার প্রকৃত চাহিদাগুলো আসলে কী? কোনো বেসরকারি অথবা সরকারি সেবামূলক কার্যক্রম কি রয়েছে, যা কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প সমাধান প্রদান করে থাকে? তিনি কি বাসস্থান পরিবর্তন করতে চান? যদি চান, তাহলে মায়ের জীবনযাপন কোন কোন উপায়ে প্রভাবিত হবে? তাকে কি তার বন্ধুবান্ধব ছেড়ে চলে আসতে হবে? এটা কীভাবে তাকে আবেগগতভাবে প্রভাবিত করতে পারে? আপনি কি এই বিষয়গুলো নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন? এইরকম পরিবর্তন আপনাকে, আপনার সাথিকে ও আপনার সন্তানদেরকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে? যদি আপনার মায়ের যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে কে তা নেবে? সেই দায়িত্ব কি ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে? যারা এতে সরাসরি জড়িত, আপনি কি তাদের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছেন?

৮. আপনার বয়স্ক বাবা-মাদের কীভাবে সাহায্য করা যায়, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আপনি কাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন?

যেহেতু যত্ন নেওয়ার দায়িত্বের সঙ্গে একটা পরিবারের সমস্ত সন্তান যুক্ত রয়েছে, তাই পরিবারগতভাবে আলোচনা করা বিজ্ঞতার কাজ, যাতে সকলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া, খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর প্রাচীনদের সঙ্গে অথবা একইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে এমন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলা উপকারজনক হতে পারে। “পরামর্শের অভাবে পরিকল্পনা মিথ্যা হয়ে যায়,” বাইবেল সতর্ক করে, “কিন্তু পরামর্শদাতা অনেক হলে পরিকল্পনা সফল হয়।”—হিতোপদেশ ১৫:২২, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন।

সহমর্মী হোন ও অনুভূতি বুঝুন

৯, ১০. (ক) বয়স বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও, বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি কোন বিবেচনা দেখানো উচিত? (খ) একজন প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান তার বাবা-মায়ের জন্য যে-পদক্ষেপই গ্রহণ করুক না কেন, বাবা-মাকে তার সবসময় কী দেওয়া উচিত?

আমাদের বয়স্ক বাবা-মাকে সমাদর করার জন্য সহমর্মিতা দেখানো ও অনুভূতি বোঝা প্রয়োজন। বার্ধক্যের গুরুতর পরিণতিগুলোর সঙ্গে সঙ্গে বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে হয়তো চলাফেরা করা, খাওয়াদাওয়া করা এবং স্মরণে রাখাকে ক্রমান্বয়ে কষ্টকর বলে মনে হতে পারে। তাদের হয়তো সাহায্যের প্রয়োজন। বেশিরভাগ সময়ই সন্তানরা বাবা-মায়ের নিরাপত্তা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং নির্দেশনা প্রদান করার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু, বয়স্ক ব্যক্তিরা হল এমন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি, যারা জীবনভর অনেক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এবং নিজেদের যত্ন ও সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিয়েছে। তাদের পরিচয় ও আত্মসম্মান হয়তো বাবা-মা এবং প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে তাদের ভূমিকার ওপর কেন্দ্রীভূত। যে-বাবা-মায়েরা মনে করে যে, তাদেরকে অবশ্যই নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রণের ভার তাদের সন্তানদের ওপর অর্পণ করতে হবে, তারা হয়তো বিষণ্ণ হয়ে পড়ে বা রেগে যায়। কেউ কেউ তাদের কাছ থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে করে অসন্তুষ্ট হয় ও বিরোধিতা করে।

১০ এই ধরনের সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই, তবে বয়স্ক ব্যক্তিদেরকে নিজেদের যত্ন এবং যতদূর সম্ভব তাদের সিদ্ধান্ত তাদেরকেই নিতে দেওয়া হল দয়ার কাজ। আপনার বাবা-মায়ের জন্য কোনটা সর্বোত্তম, সেই বিষয়ে প্রথমে তাদের সঙ্গে কথা না বলেই সিদ্ধান্ত না নেওয়া বিজ্ঞতার কাজ। বয়সের কারণে তারা হয়তো অনেক কিছু হারিয়েছে। তাই, এখনও তাদের যা আছে, তা রাখতে দিন। আপনি হয়তো দেখতে পারেন যে, তাদের জীবনকে যত কম নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন, তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ততই ভাল হবে। তারা আরও বেশি সুখী হবে ও সেইসঙ্গে আপনিও সুখী হবেন। এমনকি যদিও তাদের মঙ্গলের জন্য কিছু কিছু বিষয়ে জোর করা আবশ্যক, তবুও আপনার বাবা-মাকে সমাদর করার অর্থ তারা যে-মর্যাদা এবং সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তা প্রদান করা। ঈশ্বরের বাক্য পরামর্শ দেয়: “তুমি পক্বকেশ প্রাচীনের সম্মুখে উঠিয়া দাঁড়াইবে, বৃদ্ধ লোককে সমাদর করিবে।”—লেবীয় পুস্তক ১৯:৩২.

সঠিক মনোভাব বজায় রাখা

১১-১৩. একজন প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের সম্পর্ক যদি অতীতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাল না-ও থাকে, তবুও কীভাবে সেই সন্তান বাবা-মায়ের বৃদ্ধ বয়সে তাদের যত্ন নেওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবিলা করতে পারেন?

১১ বয়স্ক বাবা-মাকে সম্মান করার ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানরা মাঝে মাঝে যে-সমস্যাটার সম্মুখীন হয়ে থাকে, তার অন্তর্ভুক্ত ছেলেবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে বিদ্যমান তাদের সম্পর্ক। আপনার বাবা হয়তো আবেগঅনুভূতিহীন ও দয়ামায়াহীন ছিলেন আর মা কর্তৃত্বপরায়ণ ও কঠোর ছিলেন। আপনি হয়তো এখনও হতাশাগ্রস্ত, ক্রোধান্বিত হতে অথবা কষ্ট অনুভব করতে পারেন কারণ তারা এমন বাবা-মা ছিলেন না, যেমনটা আপনি চাইতেন। আপনি কি এই ধরনের অনুভূতি কাটিয়ে উঠতে পারেন? a

১২ বাস্‌ নামে একজন ব্যক্তি, যিনি ফিনল্যান্ডে বড় হয়েছিলেন, তিনি বলেন: “আমার সৎবাবা নাতসি জার্মানিতে একজন এসএস কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি অল্পতেই রেগে যেতেন ও তারপর অত্যন্ত সাংঘাতিক হয়ে উঠতেন। তিনি আমার চোখের সামনেই আমার মাকে অনেক বার মারধর করেছেন। একবার তিনি যখন আমার ওপর রেগে গিয়েছিলেন, তখন তার বেল্ট ছুঁড়ে মেরে সেটার বগল্‌স দিয়ে আমার মুখমণ্ডলে আঘাত করেছিলেন। এর ফলে আমি এত জোরে আঘাত পেয়েছিলাম যে, আমি বিছানার ওপর পড়ে গিয়েছিলাম।”

১৩ তবে, তার চরিত্রের ভিন্ন দিকও ছিল। বাস্‌ আরও বলেন: “অন্যদিকে, তিনি কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং পরিবারের বস্তুগত ভরণপোষণ জোগানোর ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি করতেন না। যদিও তিনি আমার প্রতি কখনো পিতৃস্নেহ দেখাননি কিন্তু আমি জানতাম যে, তিনি আবেগগত দিক দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন। তিনি একদম ছোটো থাকতেই তার মা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তিনি ছোটোবেলা থেকেই সবসময় মারামারি করতেন এবং যুবক বয়সে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আমি তার অবস্থা কিছুটা বুঝতে পারতাম আর তাই তাকে দোষ দিতাম না। আমি যখন বড় হয়েছি, তখন তার মৃত্যু পর্যন্ত যতদূর সম্ভব তাকে সাহায্য করতে চেয়েছি। এটা সহজ ছিল না কিন্তু আমি আমার যথাসাধ্য করেছি। আমি তার মৃত্যু পর্যন্ত এক উত্তম ছেলে হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আর আমার মনে হয় তিনি আমাকে সেভাবেই গ্রহণ করেছিলেন।”

১৪. বয়স্ক বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়ার সময় দেখা দেয় এমন পরিস্থিতিগুলোসহ সমস্ত পরিস্থিতিতে কোন শাস্ত্রপদ প্রযোজ্য?

১৪ অন্যান্য বিষয়ের মতো পারিবারিক বিষয়গুলোতেও বাইবেলের এই পরামর্শ প্রযোজ্য: “করুণার চিত্ত, মধুর ভাব, নম্রতা, মৃদুতা, সহিষ্ণুতা পরিধান কর। পরস্পর সহনশীল হও, এবং যদি কাহাকেও দোষ দিবার কারণ থাকে, তবে পরস্পর ক্ষমা কর; প্রভু [“যিহোবা,” NW] যেমন তোমাদিগকে ক্ষমা করিয়াছেন, তোমরাও তেমনি কর।”—কলসীয় ৩:১২, ১৩.

যারা যত্ন নেয়, তাদেরও যত্নের প্রয়োজন

১৫. কেন বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়া মাঝে মাঝে কষ্টকর হয়?

১৫ শারীরিকভাবে দুর্বল এমন একজন বাবা অথবা মায়ের যত্ন নেওয়া কঠিন বিষয়, যেটার সঙ্গে অনেক কাজ, প্রচুর দায়িত্ব ও দীর্ঘসময় যুক্ত রয়েছে। কিন্তু, বেশিরভাগ সময়ই সবচেয়ে কঠিন বিষয়টা হল আবেগগত সমস্যা। আপনার বাবা-মাকে তাদের স্বাস্থ্য, স্মরণশক্তি ও স্বাধীনতা হারাতে দেখা অনেক কষ্টকর। পুয়ের্টো রিকো থেকে আসা স্যান্ডি বলেন: “আমার মা-ই ছিলেন আমাদের পরিবারের প্রাণ। তার যত্ন নেওয়া অনেক বেদনাদায়ক ছিল। প্রথমে তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন; পরে তার হাঁটার জন্য লাঠির প্রয়োজন হয়, এরপর ওয়াকারের এবং সবশেষে একটা হুইলচেয়ারের প্রয়োজন হয়। তারপর মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তার অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হতে থাকে। তার বোন ক্যান্সার হয় এবং সর্বক্ষণ—রাতদিন—যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা তাকে স্নান করিয়ে দিতাম, খাইয়ে দিতাম এবং তাকে পড়ে শোনাতাম। এটা খুবই কঠিন ছিল—বিশেষভাবে আবেগগত দিক দিয়ে। আমি যখন বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার মা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন অনেক কেঁদেছিলাম কারণ আমি তাকে অনেক ভালবাসতাম।”

১৬, ১৭. কোন উপদেশ হয়তো বাবা-মায়ের যত্ন নিয়ে থাকেন এমন একজন ব্যক্তিকে বিভিন্ন বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রাখার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে?

১৬ আপনার পরিস্থিতিও যদি একইরকম হয়, তাহলে সেটার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য আপনি কী করতে পারেন? বাইবেল পাঠের মাধ্যমে যিহোবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা ও প্রার্থনার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে কথা বলা আপনাকে অনেক সাহায্য করবে। (ফিলিপীয় ৪:৬, ৭) ব্যবহারিক উপায়ে এই বিষয়টা নিশ্চিত করুন যে, আপনি পুষ্টিকর খাবারদাবার খাচ্ছেন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। তা করার মাধ্যমে, আপনি প্রিয়জনের যত্ন নেওয়ার জন্য আবেগগত ও দৈহিক, উভয় দিক দিয়েই আরও ভাল অবস্থানে থাকবেন। মাঝে মাঝে আপনি হয়তো রোজকার তালিকা থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। এমনকি ছুটি নেওয়া সম্ভব না হলেও, অবসরের জন্য কিছুসময় নির্ধারণ করে রাখা বিজ্ঞতার কাজ। কিছুসময় বের করার জন্য আপনি হয়তো অন্য কাউকে আপনার অসুস্থ বাবা অথবা মায়ের সঙ্গে থাকার জন্য ব্যবস্থা করতে পারেন।

১৭ বাবা-মায়ের যত্ন নিয়ে থাকেন, এমন একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির পক্ষে নিজের কাছ থেকে অযৌক্তিক কিছু প্রত্যাশা করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু, আপনি যা করতে পারেন না, সেটার জন্য নিজেকে অপরাধী বলে মনে করবেন না। আপনি যদি বাবা-মায়ের যত্ন নিয়ে থাকেন, তাহলে নিজের কাছ থেকে যুক্তিযুক্ত প্রত্যাশা করুন। আপনাকে কেবল আপনার বাবা-মায়ের চাহিদাগুলোর ক্ষেত্রেই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে আপনার সন্তানদের, আপনার সাথির ও এমনকি আপনার নিজের চাহিদাগুলোর ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে।

অসাধারণ শক্তি

১৮, ১৯. যিহোবা কোন সমর্থন সম্বন্ধে প্রতিজ্ঞা করেছেন আর কোন অভিজ্ঞতা দেখায় যে, তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখেন?

১৮ যিহোবা তাঁর বাক্য বাইবেলের মাধ্যমে প্রেমের সঙ্গে সেই নির্দেশনা জোগান, যা একজন ব্যক্তিকে তার বয়স্ক বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করতে পারে, তবে তিনি কেবল এই সাহায্যই জোগান না। “সদাপ্রভু সেই সকলেরই নিকটবর্ত্তী, যাহারা তাঁহাকে ডাকে,” অনুপ্রাণিত হয়ে গীতরচক লিখেছিলেন। “তাহাদের আর্ত্তনাদ শুনিয়া তাহাদিগকে ত্রাণ করেন।” যিহোবা তাঁর বিশ্বস্ত ব্যক্তিদেরকে এমনকি সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিগুলোর মধ্যেও ত্রাণ বা রক্ষা করবেন।—গীতসংহিতা ১৪৫:১৮, ১৯.

১৯ ফিলিপিনসের মিরনা, স্ট্রোকের কারণে অসহায় হয়ে পড়া তার মায়ের যত্ন নেওয়ার সময় এই বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলেন। “আপনার প্রিয়জনকে কষ্ট পেতে দেখার ও কোথায় তার যন্ত্রণা হচ্ছে, তা আপনাকে বলতে অসমর্থ হতে দেখার চেয়ে কষ্টকর আর কিছুই হতে পারে না,” মিরনা লেখেন। “ক্রমান্বয়ে তার অবস্থার অবনতি হতে দেখা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। আমি অনেক বার হাঁটু গেড়ে যিহোবার কাছে বলেছিলাম যে আমি কতটা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি। আমি দায়ূদের মতো আর্তনাদ করেছি, যিনি যিহোবার কাছে বিনতি করেছিলেন যেন যিহোবা তার চোখের জল কুপাতে রাখেন ও তাকে স্মরণ করেন। [গীতসংহিতা ৫৬:৮] আর যিহোবা তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী আমাকে প্রয়োজনীয় শক্তি দিয়েছিলেন। ‘সদাপ্রভু আমার অবলম্বন হইলেন।’”—গীতসংহিতা ১৮:১৮.

২০. বাইবেলের কোন প্রতিজ্ঞাগুলো বাবা-মায়ের যত্ন নিয়ে থাকে এমন ব্যক্তিদের আশাবাদী থাকতে সাহায্য করে, এমনকি যদিও তারা যাদের দেখাশোনা করছে, তারা মারা যায়?

২০ কথিত আছে যে, বয়স্ক বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়া হল “বিয়োগান্ত কাহিনির মতো।” যত্ন নেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বয়স্ক ব্যক্তিরা মারা যায়, যেমনটা মিরনার মায়ের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। কিন্তু, যারা যিহোবার ওপর নির্ভর করে, তারা জানে যে, মৃত্যুই শেষ নয়। প্রেরিত পৌল বলেছিলেন: “আমি ঈশ্বরে এই প্রত্যাশা করিতেছি যে, ধার্ম্মিক অধার্ম্মিক উভয় প্রকার লোকের পুনরুত্থান হইবে।” (প্রেরিত ২৪:১৫) যে-ব্যক্তিরা তাদের বয়স্ক বাবা-মাকে মৃত্যুতে হারিয়েছে, তারা পুনরুত্থানের আশা ও সেইসঙ্গে এই প্রতিজ্ঞা থেকে সান্ত্বনা লাভ করতে পারে যে, ঈশ্বর যে-মনোরম নতুন জগৎ তৈরি করবেন, সেখানে “মৃত্যু আর হইবে না।”—প্রকাশিত বাক্য ২১:৪.

২১. বয়স্ক বাবা-মাকে সমাদর করা থেকে কোন উত্তম ফলগুলো আসে?

২১ ঈশ্বরের দাসদের তাদের বাবা-মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে, এমনকি যদিও তারা হয়তো বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছে। (হিতোপদেশ ২৩:২২-২৪) তারা তাদের সমাদর করে। তা করতে গিয়ে তারা অনুপ্রাণিত এই প্রবাদের সত্যতা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করে: “তোমার পিতামাতা আহ্লাদিত হউন, তোমার জননী উল্লাসিতা হউন।” (হিতোপদেশ ২৩:২৫) আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হল, যারা তাদের বয়স্ক বাবা-মাকে সমাদর করে, তারা যিহোবা ঈশ্বরকেও খুশি করে ও সমাদর করে।

a আমরা এমন পরিস্থিতিগুলো নিয়ে আলোচনা করছি না, যেখানে বাবা-মা তাদের ক্ষমতা ও তাদের ওপর নির্ভরতার এত চরম অপব্যবহারের দোষে দোষী যে, সেটাকে হয়তো দণ্ডণীয় অপরাধ বলে দেখা যেতে পারে।