সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় ২৬

“আপনাদের মধ্যে এক জনও মারা যাবেন না”

“আপনাদের মধ্যে এক জনও মারা যাবেন না”

জাহাজডুবির শিকার হওয়ার পরও পৌল দেখিয়েছিলেন যে, তিনি বিশ্বাসে দৃঢ় রয়েছেন এবং লোকদের ভালোবাসেন

প্রেরিত ২৭:১–২৮:১০ পদের উপর ভিত্তি করে

১, ২. পৌল কোন যাত্রায় যাবেন এবং তার মনে হয়তো কোন প্রশ্নগুলো এসেছিল?

 ফীষ্টের এই কথাটা পৌলের কানে বার বার বাজছে “তুমি কৈসরের কাছেই যাবে।” তিনি হয়তো চিন্তা করছিলেন, তিনি যখন রোমে যাবেন, তখন তার প্রতি কী ঘটবে। প্রায় দু-বছর কেটে গিয়েছে পৌল কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু, এখন রোমের এই যাত্রা কিছুদিনের জন্য হলেও তাকে এক অন্য পরিবেশ দেবে। (প্রেরিত ২৫:১২) পৌল আগেও অনেক বার জাহাজে করে যাত্রা করেছেন। কিন্তু, যখনই তিনি তার আগের যাত্রাগুলোর কথা মনে করেন, তখন সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাস এবং খোলা আকাশের পরিবর্তে, তার সেই ভয়ানক বিপদের কথাগুলো মনে পড়ে, যেগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি গিয়েছিলেন। তাই, এই যাত্রা নিয়ে তিনি অনেক চিন্তিত ছিলেন। আর তার মনে হয়তো অনেক প্রশ্ন এসেছিল যেমন, যখন তিনি সম্রাটের কাছে যাবেন, তখন কী ঘটবে।

পৌল অনেক বার “সমুদ্রের মধ্যে . . . বিপদের মুখে” পড়েছিলেন। যেমন, তিন বার তাকে জাহাজডুবির শিকার হতে হয়েছিল আর এমনকি এক দিন এবং এক রাত সমুদ্রের অগাধ জলের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল। (২ করি. ১১:২৫, ২৬) কিন্তু, এই বার তার যাত্রাটা একেবারে ভিন্ন। তিনি একজন বন্দি হিসেবে যাচ্ছেন তার উপর আবার কৈসরিয়া থেকে রোমের দূরত্ব প্রায় ৩০০০ কিলোমিটারেরও বেশি। তিনি কি সুরক্ষিতভাবে রোমে পৌঁছাতে পারবেন? যদি তিনি সুরক্ষিতভাবে পৌঁছেও যান, তা হলে কি সেখানে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে? এই প্রশ্নের কারণ হল পৌলের বিচার যিনি করতে যাচ্ছেন, তিনি সেইসময়ে শয়তানের জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন।

৩. পৌল কোন বিষয়ে দৃঢ় ছিলেন এবং এই অধ্যায়ে আমরা কী নিয়ে আলোচনা করব?

এখন পর্যন্ত আপনি পৌলের বিষয়ে অনেক কিছু পড়েছেন। আপনার কি মনে হয়, সামনে যে-বিপদগুলো আসতে চলেছে, সেগুলো নিয়ে চিন্তা করে পৌল নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন অথবা সাহস হারিয়ে ফেলছেন? একেবারেই না। তিনি এটা তো জানতেন যে, তার সামনে বিপদ আসতে চলেছে। কিন্তু, কোন কোন বিপদ আসতে চলেছে, তিনি তা নির্দিষ্টভাবে জানতেন না। তাই, যে-বিষয়টা তিনি জানতেন না, সেই বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করেননি কারণ অতিরিক্ত চিন্তা করলে তিনি প্রচার কাজের আনন্দ হারিয়ে ফেলবেন। (মথি ৬:২৭, ৩৪) পৌল জানতেন, যিহোবার এটাই ইচ্ছা যেন তিনি সমস্ত লোকের কাছে এমনকি বড়ো বড়ো আধিকারিকদের কাছে সাক্ষ্য দেন। (প্রেরিত ৯:১৫) পৌল এই বিষয়ে দৃঢ় ছিলেন যে, তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে তার এই দায়িত্ব পালন করবেন। আমরাও কি পৌলের মতো একই মনোভাব রাখি? তাই আসুন, আমরা পৌলের সঙ্গে এই সুন্দর যাত্রায় বেরিয়ে পড়ি আর দেখি, তার কাছ থেকে আমরা কী কী শিখতে পারি।

“বাতাস আমাদের বিপরীত দিকে বইছিল” (প্রেরিত ২৭:১-৭ক)

৪. পৌল কোন ধরনের জাহাজে যাত্রা করেছিলেন এবং সেই যাত্রায় কারা তার সঙ্গী ছিলেন?

পৌল এবং অন্যান্য বন্দিদের যুলিয় নামে একজন রোমীয় সেনাপতির হাতে তুলে দেওয়া হয়। যুলিয় তাদের সবাইকে কৈসরিয়ায় একটা মালবাহী জাহাজে তোলেন। এই জাহাজটা এশিয়া মাইনরের পশ্চিম উপকূল আদ্রামুত্তীয় নামে একটা বন্দর থেকে এসেছে। এই জাহাজ কৈসরিয়া থেকে উত্তর দিকে এবং তারপর পশ্চিম দিকে যাবে। পথে যেতে যেতে এই জাহাজ মালপত্র নামাবে এবং ওঠাবে। এই ধরনের জাহাজে যাত্রীদের জন্য কোনো সুযোগসুবিধা থাকত না আর বন্দিদের জন্য তো একেবারেই না। (“ সমুদ্র যাত্রা এবং বাণিজ্যিক পথ” শিরোনামের বাক্সটা দেখুন।) তবে এটা ভালো যে, জাহাজে অপরাধীদের মধ্যে পৌল একাই খ্রিস্টান নন। তার সঙ্গে তার দুই বন্ধু আরিষ্টার্খ ও লূক রয়েছেন। এই লূকই যাত্রার পুরো বিবরণ লিখেছিলেন। পৌলের এই সঙ্গীরা পৌলের সেবক হিসেবে যাত্রা করেছিলেন না কি তারা নিজেরা ভাড়া দিয়ে যাত্রা করেছিলেন, আমরা তা জানি না।—প্রেরিত ২৭:১, ২.

৫. সীদোনে পৌল কাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন আর এখান থেকে আমরা কী শিখতে পারি?

জাহাজ কৈসরিয়া থেকে রওনা দিয়ে উত্তরে প্রায় ১১০ কিলোমিটার যাত্রা করে এবং এর পরের দিন সিরিয়া উপত্যকার সীদোন বন্দরে পৌঁছায়। এইরকম মনে করা হয়, যুলিয় পৌলের সঙ্গে অপরাধীদের মতো আচরণ করেননি। এর কারণ হতে পারে, পৌল একজন রোমীয় নাগরিক এবং তার অপরাধ এখনও প্রমাণিত হয়নি। (প্রেরিত ২২:২৭, ২৮; ২৬:৩১, ৩২) আর এই জন্যই হয়তো সীদোন পৌঁছানোর পর, যুলিয় পৌলকে তার খ্রিস্টান ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেন। ভাই-বোনেরা যারা অনেক দিন পর পৌলের সঙ্গে দেখা করেছিল, তারা হয়তো পৌলকে আতিথেয়তা দেখিয়ে কতই-না খুশি হয়েছিলেন! আপনিও কি ভাই-বোনদের আতিথেয়তা দেখানোর জন্য সুযোগ খুঁজতে পারেন? এমনটা করার মাধ্যমে আপনি অনেক উৎসাহিত হবেন।—প্রেরিত ২৭:৩.

৬-৮. (ক) সীদোন থেকে পৌলের জাহাজ কোথায় কোথায় গিয়েছিল? (খ) পৌল হয়তো কোন কোন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রচার করেছিলেন?

এরপর জাহাজ সীদোন থেকে বেরিয়ে উত্তরে কিলিকিয়ার পাশ দিয়ে যায়, যেখানে পৌলের নিজের নগর তার্ষ ছিল। লূক তার বিবরণে বলেননি যে, এই সময়ের মধ্যে জাহাজ কোথায় কোথায় থেমেছিল। কিন্তু, তিনি একটা বিপদের কথা অবশ্যই বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “বাতাস আমাদের বিপরীত দিকে বইছিল।” (প্রেরিত ২৭:৪, ৫) এইরকম পরিস্থিতির মধ্যেও পৌল সাক্ষ্য দেওয়ার একটা সুযোগও হাতছাড়া করেননি আর তিনি অবশ্যই অন্যান্য বন্দিদের এবং জাহাজে যত লোক ছিল, যেমন নাবিক ও অন্যান্য সৈন্যদের কাছে প্রচার করেছিলেন। এমনকি জাহাজ যেখানে যেখানে থেমেছিল, সেখানেও তিনি হয়তো সুসমাচার জানিয়েছিলেন। বর্তমানে, আমাদের সামনে যখন সাক্ষ্য দেওয়ার বিভিন্ন সুযোগ আসে, তখন আমরাও পৌলের মতো সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে চাই।

জাহাজ যেতে যেতে এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ উপকূলে মুরা বন্দরে এসে পৌঁছায়। এখান থেকে পৌল এবং অন্যান্য যাত্রীদের আরেকটা জাহাজে উঠতে হবে, যেটা সরাসরি তাদের গন্তব্য রোমে পৌঁছে দেবে। (প্রেরিত ২৭:৬) মিশর থেকে আসা কিছু জাহাজ মুরা বন্দরে থামত, যে-জাহাজগুলোতে শস্য ভরা থাকত। সেই সময় রোমের জন্য শস্য মিশর থেকেই আসত। যুলিয় যখন এইরকম একটা জাহাজ দেখতে পান, তখন তিনি সৈন্য ও বন্দিদের সেই জাহাজে উঠতে বলেন। এই জাহাজটা আগের জাহাজের চেয়ে অনেক বড়ো ছিল কারণ এতে প্রচুর শস্য ছিল আর পাশাপাশি ২৭৬ জন যাত্রীও ছিল। এই জাহাজে নাবিক, সৈনিক, বন্দি এবং অন্যান্য লোকেরাও ছিল, যারা রোমে যাচ্ছিল। এই জাহাজ ছিল পৌলের প্রচার কাজের জন্য এক বড়ো এলাকা আর তিনি নিশ্চয়ই এই সুযোগকে ভালোভাবে কাজে লাগান।

জাহাজটা মুরা বন্দর থেকে রওনা দেয়। এরপর জাহাজটা এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ক্লীদ দ্বীপে, পৌঁছাবে। সাধারণত আবহাওয়া ভালো থাকলে মুরা থেকে ক্লীদ দ্বীপ পৌঁছাতে এই জাহাজের এক দিন সময় লাগে। কিন্তু এখন, আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে। লূক বলেন, “বেশ কিছুদিন ধীরে ধীরে চলার পর, আমরা অনেক কষ্টে ক্লীদ দ্বীপে এলাম।” (প্রেরিত ২৭:৭ক) (“ ভূমধ্যসাগরে বাতাস যখন জাহাজের বিপরীত দিকে বয়ে যায়” শিরোনামের বাক্সটা দেখুন।) প্রচণ্ড জোরে বাতাস বইছে আর এর সঙ্গে সঙ্গে জলের ঢেউগুলো জাহাজে এসে লাগছে। একটু কল্পনা এইরকম পরিস্থিতিতে সেই লোকদের অবস্থা কেমন ছিল।

“ঝড়ের কারণে জাহাজটা ভীষণভাবে দুলছিল” (প্রেরিত ২৭:৭খ-২৬)

৯, ১০. ক্রীতী দ্বীপে পৌঁছানোর পর কোন কোন বিপদ এসেছিল?

জাহাজের প্রধান নাবিক এমনটা মনে করেছিলেন, ক্লীদ দ্বীপ থেকে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাবেন। কিন্তু, এমনটা সম্ভব হয়নি। লূক বলেন, “বাতাসের কারণে আমরা এগিয়ে যেতে পারছিলাম না।” (প্রেরিত ২৭:৭খ) এতক্ষণ সমুদ্রের যে-স্রোত জাহাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সেটা বন্ধ হয়ে যায় আর উত্তর-পশ্চিম থেকে আসা ঝোড়ো বাতাস জাহাজকে দক্ষিণ দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। ঝড় থেকে বাঁচার জন্য জাহাজ ক্রীতী দ্বীপের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে যায়। ক্রীতী দ্বীপ সেই জাহাজকে ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিল, ঠিক যেমন আগের জাহাজকে সাইপ্রাস দ্বীপ রক্ষা করেছিল। জাহাজ যখন ক্রীতী দ্বীপের পূর্ব দিকে সল্‌মোনীর সামনে দিয়ে যেতে শুরু করে, তখন বিপদ কিছুটা কেটে যায়। এর কারণ হল ক্রীতী দ্বীপের দক্ষিণে বাতাসের গতি কম। আপনি হয়তো চিন্তা করতে পারেন, জাহাজের যাত্রীরা কতটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল! কিন্তু, নাবিকেরা আর একটা বিপদ নিয়ে চিন্তিত, তা হল শীত প্রায় এসে গিয়েছে আর এই পরিস্থিতিতে জাহাজে করে যাত্রা করা অনেক কঠিন হতে পারে।

১০ লূক এই ঘটনার সঠিক বিবরণ দিয়ে বলেন, “উপকূল ঘেঁষে এগিয়ে যেতে যেতে অনেক কষ্টে আমরা সুন্দর পোতাশ্রয় নামে এক জায়গায় এলাম।” যদিও জাহাজটা ক্রীতী দ্বীপের আড়ালে আড়ালে চলছে, তারপরও সেটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হচ্ছে। অবশেষে, তারা একটা ছোটো খাঁড়িতে নোঙর ফেলার জন্য জায়গা খুঁজে পায়। এমনটা মনে করা হয়, এই খাঁড়ি থেকে কিছুটা দূরেই ক্রীতী দ্বীপটা উত্তর দিকে বাঁক নেয়। সেখানে তারা কতটা সময় থাকেন? লূক বলেন, এখানে তারা “অনেক দিন” পর্যন্ত ছিলেন, কিন্তু আশার কোনো আলোই দেখতে পাচ্ছিলেন না। সময়টা ছিল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, যে-সময়ে সমুদ্রযাত্রা করা অনেক বিপদজনক।—প্রেরিত ২৭:৮, ৯.

১১. পৌল কোন পরামর্শ দিয়েছিলেন আর জাহাজের লোকেরা কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?

১১ ভূমধ্যসাগরে যাত্রা করার অভিজ্ঞতা পৌলের অনেক বেশি ছিল। তাই, কিছু যাত্রী পৌলের কাছ থেকে পরামর্শ চান যে, এখন তাদের কী করা উচিত। পৌল পরামর্শ দিয়েছিলেন জাহাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না কারণ এগিয়ে গেলে জাহাজ ডুবে যাবে, মালপত্রের “ক্ষতি হবে” আর এমনকি তারা মারাও যেতে পারে। কিন্তু, জাহাজের প্রধান নাবিক এবং মালিক এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা হয়তো মনে করেছিলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা সুরক্ষিত জায়গায় যাওয়া ভালো হবে। তাই, তারা যুলিয়কেও রাজি করিয়েছিলেন। এ ছাড়া, জাহাজের বেশিরভাগ যাত্রী পরামর্শ দিয়েছিল, সমুদ্রের উপকূল ধরে এগিয়ে যেতে হবে এবং যেকোনো প্রকারে ফিনিক্স বন্দরে পৌঁছাতে হবে। ফিনিক্স একটা বড়ো বন্দর ছিল। তাই, তারা মনে করেছিল সেখানে গিয়ে শীত কাল কাটানো ভালো হবে। তারপর, যখন মৃদু দক্ষিণা বাতাস বইতে লাগল, তখন তারা জাহাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। তারা মনে করেছিল, আবহাওয়া এখন ভালো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, তাদের এই ধারণা ছিল একেবারেই ভুল।—প্রেরিত ২৭:১০-১৩.

১২. (ক) ক্রীতী ছেড়ে যাওয়ার পর, জাহাজ কোন কোন বিপদের মুখোমুখি হয়েছিল? (খ) জাহাজকে রক্ষা করার জন্য নাবিকেরা কী কী করেছিল?

১২ তারা সুন্দর পোতাশ্রয় থেকে কিছু দূর এগিয়ে গেলে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে “এক প্রচণ্ড ঝড় উঠল,” আর সেই জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ল। এরপর, তারা “কৌদা নামে এক ছোটো দ্বীপের” আড়ালে চলে গেল আর সেখানেই কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় নিল। এই দ্বীপটা সুন্দর পোতাশ্রয় থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে ছিল। কিন্তু, এখনও একটা বিপদ রয়েছে। ঝোড়ো হওয়া জাহাজকে ধাক্কা দিয়ে দক্ষিণ দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে জাহাজটা আফ্রিকার উপকূলের বালির চরে ধাক্কা খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। এইসব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নাবিকেরা প্রথমে জাহাজের পিছনে থাকা ডিঙিনৌকাকে উপর দিকে তুলে নিল। তারা সেটা তোলার জন্য সমস্ত গায়ের জোর লাগায় কারণ সেটা হয়তো জলে ভরে গিয়েছিল। এরপর, সেই জাহাজকে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত মোটা মোটা দড়ি কিংবা শিকল দিয়ে বেঁধে দিল, যাতে তক্তাগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে জুড়ে থাকে। এবার তারা পাল নামিয়ে দেয় এবং সেই ঝড়ের মাঝে জাহাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। একটু কল্পনা করুন, পরিস্থিতিটা কতটা ভয়ঙ্কর ছিল! এই সমস্ত কিছু করার পরও, “জাহাজটা ভীষণভাবে দুলছিল।” তৃতীয় দিনে তারা জাহাজের সরঞ্জাম সমুদ্রে ফেলে দিতে লাগল, যাতে জাহাজটা হালকা হয়ে যায় এবং সমুদ্রে ভাসতে থাকে।—প্রেরিত ২৭:১৪-১৯.

১৩. জাহাজের যাত্রীদের অবস্থা কেমন ছিল?

১৩ জাহাজের লোকেরা আতঙ্কিত রয়েছে, কিন্তু পৌল এবং তার সঙ্গীরা নিশ্চিত যে, তাদের কিছু হবে না। যিশু পৌলের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, পৌল রোমে যাবেন এবং সাক্ষ্য দেবেন। (প্রেরিত ১৯:২১; ২৩:১১) এই বিষয়টাই পরে একজন স্বর্গদূত নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু ঝড় এখনও থামেনি। দু-সপ্তাহ ধরে এই প্রবল ঝড় সবাইকে আতঙ্কিত করে রেখেছে। আকাশটা কালো ঘন মেঘে ছেয়ে রয়েছে আর বৃষ্টি হয়েই চলেছে। সূর্য ও তারা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাই, জাহাজের প্রধান নাবিক বুঝতে পারছেন না, জাহাজ এখন কোথায় রয়েছে এবং কোন দিকে যাচ্ছে। জাহাজের যাত্রীদের অবস্থা খুবই খারাপ। কেউ কেউ আতঙ্কিত রয়েছে এবং কেউ কেউ সমুদ্র যাত্রা করার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আবার কিছু লোক বৃষ্টি ও ঠাণ্ডার কারণে ঠক ঠক করে কাঁপছে। এইরকম পরিস্থিতিতে কি খাওয়ার কথা কেউ চিন্তা করতে পারে?

১৪, ১৫. (ক) পৌল আবারও কোন কথা তুলেছিলেন এবং কেন? (খ) পৌল লোকদের প্রত্যাশার বিষয়ে যে-সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, সেখান থেকে আমরা কী শিখতে পারি?

১৪ পৌল সেই লোকদের কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়ান। তিনি বলেন যে, তিনি আগেই সতর্ক করেছিলেন জাহাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু, কেন পৌল সেই কথাটা আবারও তোলেন? লক্ষ করুন তিনি তাদের ভুল ধরার জন্য এটা বলেননি, ‘আমি তো তোমাদের আগেই বলেছিলাম’ বরং তিনি শুধু বলতে চেয়েছিলেন, তারা যদি তার কথায় কান দিত, তা হলে এত সমস্যা ভোগ করতে হত না। এরপর তিনি বলেন, “আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, সাহস করুন, কারণ আপনাদের মধ্যে এক জনও মারা যাবেন না, কেবল এই জাহাজটা ডুবে যাবে।” (প্রেরিত ২৭:২১, ২২) পৌলের এই কথাগুলো শুনে লোকেরা হয়তো স্বস্তি লাভ করেছিল আর পৌলও নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলেন যে, ঈশ্বর তার মাধ্যমে লোকদের এই আশার বার্তা জানিয়েছেন। এখান থেকে আমরা কী শিখতে পারি? এটাই যে, যিহোবার কাছে প্রতিটা মানুষের জীবন মূল্যবান। প্রেরিত পিতর লিখেছিলেন, “যিহোবা . . . চান না, কেউ ধ্বংস হয়ে যাক, বরং চান যেন সকলে অনুতপ্ত হয়।” (২ পিতর ৩:৯) তাই, আমাদেরও যত বেশি সম্ভব লোকদের কাছে আশার বার্তা জানাতে হবে, কারণ তাদের জীবন ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

১৫ পৌল হয়তো আগেও জাহাজে থাকা লোকদের কাছে “ঈশ্বর যে-প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেই প্রতিজ্ঞার উপর প্রত্যাশা” রাখার বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। (প্রেরিত ২৬:৬; কল. ১:৫) কিন্তু এখন, জাহাজ যখন ডুবতে চলেছে, তখন তিনি তাদের কাছে আরেকটা প্রত্যাশা সম্বন্ধে জানান যে, তারা সবাই এই ঝড় থেকে রক্ষা পাবে। এই বিষয়টার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য তিনি বলেন, “আমি যে-ঈশ্বরের উপাসনা করি এবং যাঁকে পবিত্র সেবা প্রদান করি, তাঁর একজন স্বর্গদূত গত রাতে আমার পাশে দাঁড়ালেন এবং বললেন: ‘পৌল, ভয় কোরো না। তোমাকে কৈসরের সামনে দাঁড়াতে হবে, আর দেখো! ঈশ্বর তোমাকে এবং যারা তোমার সঙ্গে জাহাজে রয়েছে, তাদের সবাইকে রক্ষা করবেন।’” এরপর, পৌল তাদের উৎসাহ দিয়ে বলেন, “সাহস করুন, কারণ ঈশ্বরের উপর আমার এই বিশ্বাস রয়েছে যে, আমাকে যেমনটা বলা হয়েছে, ঠিক তেমনটাই ঘটবে। তবে, কোনো একটা দ্বীপের কাছে গিয়ে আমাদের জাহাজডুবি হবে।”—প্রেরিত ২৭:২৩-২৬.

“সকলে নিরাপদে তীরে এসে পৌঁছাল” (প্রেরিত ২৭:২৭-৪৪)

“তিনি . . . সকলের সামনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন।”—প্রেরিত ২৭:৩৫

১৬, ১৭. (ক) পৌল কখন প্রার্থনা করেছিলেন এবং এর কোন ফলাফল হয়েছিল? (খ) পৌলের কথাগুলো কীভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল?

১৬ দু-সপ্তাহ ধরে জাহাজে লোকেরা আতঙ্কে রয়েছে। প্রবল বাতাস জাহাজকে প্রায় ৮৭০ কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায়। এবার নাবিকেরা মনে করে তারা উপকূলের কাছাকাছি রয়েছে কারণ ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারা জাহাজের পিছন দিক থেকে নোঙর ফেলে দেয়, যাতে জাহাজ ভেসে না গিয়ে তীরের কাছে দাঁড়ায়। এই সময় জাহাজের নাবিকেরা নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য জাহাজ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ঠিক তখনই পৌল সেনাপতি ও সৈন্যদের বললেন, “এই লোকেরা জাহাজে না থাকলে আপনারা রক্ষা পাবেন না।” তাই, সৈন্যেরা তাদের পালাতে বাধা দেয়। জাহাজ যখন একটু নিয়ন্ত্রণে আসে, তখন পৌল লোকদের কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি আরও এক বার তাদেরকে নিশ্চয়তা দেন যে, তারা অবশ্যই রক্ষা পাবে। এরপর, পৌল “সকলের সামনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন।” (প্রেরিত ২৭:৩১, ৩৫) প্রার্থনায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়ার মাধ্যমে পৌল লূক, আরিষ্টার্খ এবং বর্তমান খ্রিস্টানদের জন্য এক উত্তম উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। অন্যদের সামনে যখন আপনার প্রার্থনা করার সুযোগ আসে, তখন আপনার প্রার্থনা কেমন হয়? সেই প্রার্থনা শুনে কি লোকেরা সাহস ও সান্ত্বনা পায়?

১৭ পৌলের প্রার্থনা শোনার পর, “তারা সকলে সাহস পেয়ে খেতে শুরু করল।” (প্রেরিত ২৭:৩৬) এরপর, তারা জাহাজকে হালকা করার জন্য গম সমুদ্রে ফেলে দিল, যাতে জাহাজ ভাসতে থাকে এবং সমুদ্রের তীরের দিকে আরও এগিয়ে যেতে পারে। সকাল হওয়ার পর, নাবিকেরা জাহাজের নোঙরগুলো কেটে জলে ফেলে দেয় এবং জাহাজের হালের বাঁধনগুলো খুলে দেয়। এরপর, তারা জাহাজের সামনের পাল তুলে দেয়, যেন জাহাজকে তীরের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু, তখনই জাহাজের সামনের দিকটা বালিতে আটকে যায়। আর জাহাজের পিছনের দিকটা ঢেউয়ের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যেতে থাকে। এটা দেখে সৈন্যেরা ঠিক করে যে, তারা বন্দিদের হত্যা করবে, যাতে কেউ সাঁতার কেটে পালিয়ে যেতে না পারে। কিন্তু, যুলিয় তাদের বাধা দেন আর সবাইকে সাঁতার কেটে অথবা কোনো কিছুর সাহায্য নিয়ে তীরে পৌঁছাতে বলেন। পৌলের কথাগুলো সত্যি বলে প্রমাণিত হয় এবং ২৭৬ জন যাত্রী সবাই রক্ষা পায়। আর “এভাবে সকলে নিরাপদে তীরে এসে পৌঁছাল।” কিন্তু, তারা কোন জায়গায় পৌঁছায়?—প্রেরিত ২৭:৪৪.

“অসাধারণ দয়া” (প্রেরিত ২৮:১-১০)

১৮-২০. (ক) কীভাবে মাল্টা দ্বীপের লোকেরা সেই যাত্রীদের প্রতি “অসাধারণ দয়া” দেখিয়েছিল? (খ) ঈশ্বর পৌলের মাধ্যমে কোন অলৌকিক কাজ করেছিলেন?

১৮ এমনটা মনে হয়, এই জায়গাটা হল মাল্টা দ্বীপ, যেটা সিসিলির দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। (“ মাল্টা দ্বীপ কোথায় অবস্থিত?” শিরোনামের বাক্সটা দেখুন) এই দ্বীপের লোকদের ভাষা এবং সংস্কৃতি একেবারেই আলাদা, তারপরও তারা সেই অচেনা যাত্রীদের প্রতি “অসাধারণ দয়া” দেখায় অর্থাৎ মানবিকতার খাতিরে তাদের সাহায্য করে। (প্রেরিত ২৮:২) সেই লোকেরা যাত্রীদের জন্য আগুন জ্বালায় কারণ তারা ভিজে গিয়েছিল, তার উপর আবার সেখানে বৃষ্টি হওয়ায় ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপছিল। সেই আগুনের তাপে যাত্রীরা বেশ আরাম পায়। এরপর একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে।

১৯ অন্যদের মতো পৌলও কাঠ জোগাড় করে আগুনের মধ্যে ফেলছেন। ঠিক তখনই একটা বিষধর সাপ বেরিয়ে আসে আর পৌলের হাতে কামড়ে দেয়। এটা দেখে মাল্টা দ্বীপের লোকেরা মনে করল, এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই কোনো পাপ করেছে, তাই দেবী তাকে শাস্তি দিয়েছেন। a

২০ মাল্টা দ্বীপের লোকেরা মনে করেছিল, এবার পৌলের “দেহ ফুলে উঠবে।” একটা বই অনুযায়ী, “দেহ ফুলে উঠবে” এই জায়গায় মূল ভাষায় যে-শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সেই শব্দ সাধারণত ডাক্তাররা ব্যবহার করে। এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি, কেন লূক এই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন কারণ তিনি নিজেই একজন “চিকিৎসক” ছিলেন। (প্রেরিত ২৮:৬; কল. ৪:১৪) কিন্তু, পৌল নিজের হাত ঝেড়ে সাপটাকে নীচে ফেলে দেন এবং তার কোনো ক্ষতি হয় না। এটা সত্যিই ঈশ্বরের এক অলৌকিক কাজ!

২১. (ক) কিছু উদাহরণের সাহায্যে বলুন, কীভাবে লূক তার বিবরণে একদম সঠিক তথ্য দিয়েছিলেন। (খ) পৌল মাল্টা দ্বীপে কোন অলৌকিক কাজ করেছিলেন আর এরপর লোকেরা কী করেছিল?

২১ মাল্টা দ্বীপে পুব্লিয় নামে একজন জমিদার থাকতেন। তিনি হয়তো এই দ্বীপের রোমীয় আধিকারিকদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ছিলেন। লূক তাকে সেই “দ্বীপের শাসনকর্তা” বলে উল্লেখ করেন। মাল্টা দ্বীপে পাওয়া দুটো শিলালিপিতে এই উপাধি ব্যবহার করা হয়েছে। এখান থেকে বোঝা যায় যে, লূক একেবারে সঠিক তথ্য তুলে ধরেছিলেন। পুব্লিয় তিন দিন ধরে পৌল এবং তার সঙ্গীদের আতিথেয়তা দেখান। সেইসময় পুব্লিয়ের বাবা অসুস্থ ছিলেন। একবার আবারও লূক একদম সঠিক তথ্য দিয়েছিলেন যে, কোন অসুখ হয়েছিল। তিনি ডাক্তারি ভাষায় বলেন, পুব্লিয়ের বাবা “জ্বর ও আমাশয়ের কারণে অসুস্থ” ছিলেন। পৌল যখন পুব্লিয়ের বাবার জন্য প্রার্থনা করেন এবং তার উপর হাত রাখেন, তখন তিনি সুস্থ হয়ে যান। এই অলৌকিক কাজ দেখে সেখানকার লোকেরা পৌলের কাছে অনেক অসুস্থ ব্যক্তিকে নিয়ে আসে আর তিনি তাদের সবাইকে সুস্থ করেন। এরপর লোকেরা পৌল এবং তার সঙ্গীদের উপহার হিসেবে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস দেয়।—প্রেরিত ২৮:৭-১০.

২২. (ক) লূকের বিবরণের প্রশংসা করে একজন প্রফেসর কী বলেছিলেন? (খ) পরের অধ্যায়ে আমরা কী নিয়ে আলোচনা করব?

২২ এখন পর্যন্ত আমরা পৌলের যাত্রার বিবরণ সম্বন্ধে যা-কিছু পড়েছি, তা একেবারে সঠিক। এই বিষয়টা একজন প্রফেসারও মেনে নিয়েছিলেন। তিনি বলেন: ‘পুরো বাইবেলে লূকের বিবরণ সবচেয়ে আগ্রহজনক কারণ এখানে ঘটনার সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বিবরণে বলা হয়েছে, প্রথম শতাব্দীর নাবিকেরা জাহাজকে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কোন কোন পদ্ধতি কাজে লাগাত এবং ভূমধ্যসাগরের পূর্ব দিকে আবহাওয়া কেমন থাকত। এত নিখুঁত তথ্য পড়ার সময় এমনটা মনে হয়, যখন এই ঘটনাগুলো ঘটছিল, তখন কেউ যেন এর প্রত্যেকটা বিষয় একটা ডায়েরিতে লিখে রাখছিল।’ লূক হয়তো এমনটাই করেছিলেন। এরপর পৌল যখন মাল্টা দ্বীপ থেকে আবার যাত্রা শুরু করবেন, তখন লূকের কাছে লেখার মতো অনেক কিছু থাকবে। অবশেষে পৌল যখন রোমে পৌঁছাবেন, তখন তার প্রতি কী ঘটবে? আসুন, তা দেখি।

a এখানে বলা বিষধর সাপ হল ভাইপার প্রজাতির। সেই সময় মাল্টায় ভাইপার প্রজাতির সাপ থাকত, তাই সেখানকার লোকেরা এই সাপ সম্বন্ধে পরিচিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে, মাল্টায় এই সাপ আর পাওয়া যায় না। শত শত বছর ধরে হয়তো আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে কিংবা সেখানে জনবসতি বেড়ে যাওয়ার ফলে এই সাপ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।