সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় ২২

“যিহোবার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক”

“যিহোবার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক”

পৌল যেকোনো পরিস্থিতিতে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি জেরুসালেমে গিয়েছিলেন

প্রেরিত ২১:১-১৭ পদের উপর ভিত্তি করে

১-৪. কেন পৌল জেরুসালেমের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন এবং সেখানে তার জন্য কী অপেক্ষা করছিল?

 মিলীতের বন্দরে ইফিষের প্রাচীনেরা পৌল ও লূকের গলা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছেন। ইফিষের ভাইয়েরা বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, তারা শেষ বারের মতো পৌলকে দেখছে। পৌল ও লূকের পক্ষেও সেই প্রিয় ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া সহজ নয়, তারপরও তারা খুবই কষ্টে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে ওঠেন। ভাইয়েরা তাদের জন্য খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসও দেয়, যেন যাত্রার সময় তাদের কোনো কিছুর অভাব না হয়। পৌল ও লূক তাদের সঙ্গে করে যিহূদিয়ার ভাইদের জন্য দানও নিয়ে যাচ্ছেন। এই দান তারা যত দ্রুত সম্ভব, প্রয়োজন রয়েছে এমন ভাইদের কাছে পৌঁছে দিতে চান।

এবার জাহাজের পাল তোলা হয় আর পালে বাতাস লাগতেই সেই জাহাজ বন্দর ছেড়ে এগোতে থাকে। পৌল, লূক এবং তাদের সঙ্গে থাকা সেই সাত জন ভাই জাহাজ থেকে সেই ভাইদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যারা মন খারাপ করে সেই বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে। (প্রেরিত ২০:৪, ১৪, ১৫) যতক্ষণ তাদের দেখা যাচ্ছিল, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছিল।

পৌল ইফিষের প্রাচীনদের সঙ্গে প্রায় তিন বছর কাজ করেছিলেন। কিন্তু, এখন পবিত্র শক্তির নির্দেশনায় তিনি জেরুসালেমে যাচ্ছেন। তিনি কিছুটা হলেও জানেন যে, জেরুসালেমে তার প্রতি কী ঘটতে পারে। কিছুদিন আগে, তিনি ইফিষের প্রাচীনদের বলেছিলেন, “পবিত্র শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে আমি জেরুসালেমে যাচ্ছি, যদিও সেখানে আমার প্রতি কী ঘটবে, তা আমি জানি না। আমি কেবল এটা জানি, পবিত্র শক্তি নগরে নগরে বার বার আমাকে সতর্ক করেছে যে, আমাকে কারাগারে যেতে হবে এবং ক্লেশ ভোগ করতে হবে।” (প্রেরিত ২০:২২, ২৩) বিপদের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও পৌল “পবিত্র শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে” জেরুসালেম যাওয়ার জন্য বাধ্য ছিলেন। এই কথাগুলোর মানে হল, তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে পবিত্র শক্তির নির্দেশনা মেনে চলতে চান এবং তার সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে চান। অবশ্যই তিনি তার জীবনকে ভালোবাসতেন, কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করাকে তিনি তার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন।

ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করার ক্ষেত্রে আমাদেরও কি পৌলের মতো একই উদ্যোগ রয়েছে? আমরা যখন নিজেদের জীবন যিহোবার কাছে উৎসর্গ করেছিলাম, তখন এই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, এখন থেকে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করাই আমাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। প্রেরিত পৌল যেভাবে সারা জীবন ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি।

যাত্রায় তারা “সাইপ্রাস দ্বীপ” দেখতে পায় (প্রেরিত ২১:১-৩)

৫. পৌল এবং তার সঙ্গীরা সোর নগরে যাওয়ার জন্য কোন পথ দিয়ে যাত্রা করেছিলেন?

মিলীত থেকে পৌল এবং তার সঙ্গীদের জাহাজ “সোজা পথ ধরে দ্রুত” এগোতে থাকে। আবহাওয়া ভালো থাকার কারণে জাহাজকে দিক পরিবর্তন করতে হয়নি। এইজন্য তারা সেই দিনই কো দ্বীপে পৌঁছে যান। (প্রেরিত ২১:১) এমনটা মনে হয়, সেই দিন রাতে জাহাজ কো দ্বীপেই নোঙ্গর ফেলে। পরের দিন তারা রোদঃ দ্বীপ ও পাতারায় যাওয়ার জন্য রওনা দেন। পাতারা এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত। পৌল এবং তার সঙ্গীরা পাতারায় এক বড়ো মালবাহী জাহাজে ওঠেন, যেটা তাদের সোজা ফৈনীকিয়ার সোর নগরে পৌঁছে দেয়। যাত্রাপথে তারা ‘বাম দিকে সাইপ্রাস দ্বীপ দেখতে পায়।’ (প্রেরিত ২১:৩) এই বিবরণে কেন লূক সাইপ্রাস দ্বীপের কথা উল্লেখ করেন?

৬. (ক) সাইপ্রাস দ্বীপে যা ঘটেছিল, সেই বিষয়টা স্মরণ করে পৌল কোন বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন? (খ) অতীতে যিহোবা আপনাকে যে-আশীর্বাদগুলো করেছেন, সেগুলো ভেবে দেখা কেন ভালো হবে?

যাত্রার সময় পৌল যখন সেই দ্বীপটা দেখেন, তখন তিনি হয়তো সেখানে তার প্রতি কী ঘটেছিল, তা লূক এবং বাকি সঙ্গীদের বলেন। প্রায় ন-বছর আগে, তার প্রথম মিশনারি যাত্রায় তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। সেই সময় তার সঙ্গী বার্ণবা ও যোহন মার্কও ছিলেন। সেখানে তারা ইলুমা নামে একজন মায়াবীর মুখোমুখি হয়েছিলেন, যে তাদের বিরোধিতা করেছিল। (প্রেরিত ১৩:৪-১২) পৌল নিশ্চয়ই এই বিষয়টা স্মরণ করে অনেক শক্তিশালী হয়েছিলেন যে, কীভাবে যিহোবা সেই সময় তাকে সাহায্য করেছিলেন আর এটা থেকে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হন যে, তার সামনে যত বাধাই আসুক না কেন, তিনি সেগুলোর মোকাবিলা করতে পারবেন। আমরাও যদি ভেবে দেখি, অতীতে যিহোবা কীভাবে আমাদের আশীর্বাদ করেছেন এবং সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করেছেন, তা হলে আমরাও শক্তিশালী হব। আমরাও দায়ূদের মতো বলতে পারব: “ধার্ম্মিকের বিপদ অনেক, কিন্তু সেই সকল হইতে সদাপ্রভু তাহাকে উদ্ধার করেন।”—গীত. ৩৪:১৯.

“সেখানে আমরা শিষ্যদের খোঁজ করলাম” (প্রেরিত ২১:৪-৯)

৭. সোর নগরে পৌঁছানোর পর পৌল এবং তার সঙ্গীরা কী করেছিলেন?

পৌল জানতেন খ্রিস্টীয় ভাই-বোনদের সঙ্গে মেলামেশা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই, তিনি তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য উৎসুক ছিলেন। সোর পৌঁছানোর পর লূক বলেন, “সেখানে আমরা শিষ্যদের খোঁজ করলাম।” (প্রেরিত ২১:৪) তারা জানতেন সোর নগরে কিছু খ্রিস্টান ভাই-বোন রয়েছে, তাই তারা তাদের বাড়ি খোঁজেন এবং সেখানে গিয়ে থাকেন। বর্তমানেও, আমরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যাই না কেন, সেখানে এমন ভাই-বোনদের পাই, যারা মন থেকে আমাদের স্বাগত জানায়। সত্যে থাকার এটা হল এক বড়ো আশীর্বাদ। সত্যিই, যারা ঈশ্বরকে ভালোবাসে এবং সত্য উপাসনা করে, সারা পৃথিবীতে তাদের বন্ধু রয়েছে।

৮. প্রেরিত ২১:৪ পদে লেখা কথাগুলোর মানে কী?

পৌল এবং তার সঙ্গীরা সাত দিন সোর নগরে থাকেন। সেই সময় যা-কিছু ঘটেছিল, সেই বিষয়ে লূক লেখেন, “পবিত্র শক্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তারা [সোরের ভাইয়েরা] পৌলকে বার বার বললেন, যেন তিনি জেরুসালেমে না যান।” (প্রেরিত ২১:৪) এই শাস্ত্রপদ পড়ে আমাদের মনে হতে পারে যে, পবিত্র শক্তির জন্য ভাইয়েরা পৌলকে জেরুসালেমে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছেন, কিন্তু বিষয়টা এমন নয়। পবিত্র শক্তি স্পষ্টভাবে বলেছিল যে, পৌল জেরুসালেম যাবেন এবং সেখানে তার প্রতি খারাপ ব্যবহার করা হবে। তবে, সোরের ভাইয়েরা যখন এই বিষয়টা বুঝতে পারে, তখন তারা পৌলের জন্য চিন্তা করতে থাকে। তাই, পবিত্র শক্তি নয় বরং সেই ভাইয়েরা পৌলকে বাধা দেয়, যেন তিনি জেরুসালেমে না যান। আমরা সেই ভাইদের অনুভূতি বুঝতে পারি। তারা চায় না পৌলের উপর কোনোরকম আঘাত আসুক। কিন্তু, পৌল ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করার জন্য দৃঢ় ছিলেন। আর তাই, তিনি জেরুসালেমের উদ্দেশে রওনা দিলেন।—প্রেরিত ২১:১২.

৯, ১০. (ক) সোরের ভাইদের অনুরোধ শুনে পৌলের হয়তো কোন ঘটনার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল? (খ) বর্তমানে বেশিরভাগ লোকদের চিন্তাভাবনা কেমন আর এই ক্ষেত্রে যিশু কী বলেছিলেন?

সোরের ভাইদের অনুরোধ শুনে পৌলের হয়তো যিশুর জীবনের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। একবার যিশু তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, তাঁকে জেরুসালেমে যেতে হবে, সেখানে অনেক দুঃখ ভোগ করতে হবে আর শেষে তাঁকে হত্যা করা হবে। এই কথা শুনে পিতর থাকতে না পেরে যিশুকে বলেছিলেন: “প্রভু, নিজের প্রতি সদয় হোন; আপনার প্রতি কখনোই এমনটা ঘটবে না।” কিন্তু, যিশু তাকে বলেন: “আমার সামনে থেকে সরে যাও, শয়তান! তুমি আমার জন্য বাধাস্বরূপ, কারণ তুমি ঈশ্বরের মতো করে নয়, বরং মানুষের মতো করে চিন্তা করছ।” (মথি ১৬:২১-২৩) যিশু এই বিষয়ে একেবারে দৃঢ় ছিলেন যে, যেকোনো পরিস্থিতিতে তিনি যিহোবার ইচ্ছা পালন করবেন এবং নিজের জীবনকে বলি হিসেবে দান করবেন। পৌলও দৃঢ় ছিলেন। পিতরের মতো সোরের ভাইদের উদ্দেশ্য ভালো ছিল, তবে তাদের চিন্তাভাবনা ভুল ছিল। তারা এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল যে, ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল পৌল যেন জেরুসালেমে যান।

যিশুকে অনুকরণ করার জন্য আমাদের কিছু ত্যাগস্বীকার করতে হবে

১০ বর্তমানে লোকদের চিন্তাভাবনা এমন হয়ে গিয়েছে যে, কোনো কাজ করতে যদি তাদের কঠিন বলে মনে হয়, তা হলে সেটা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তা সেই কাজ যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন। যেমন, ধর্মের বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করুন। লোকেরা এমন ধর্মগুলো মেনে চলতে পছন্দ করে, যে-ধর্মে বেশি বিধি-নিষেধ কিংবা নিয়মকানুন নেই। কিন্তু, যিশু আমাদের এমন চিন্তাভাবনা গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেন, যা জগতের চিন্তাভাবনার একেবারে বিপরীত। তিনি তার শিষ্যদের বলেন: “কেউ যদি আমাকে অনুসরণ করতে চায়, তা হলে সে নিজেকে অস্বীকার করুক, নিজের যাতনাদণ্ড তুলে নিক এবং আমাকে অনুসরণ করে চলুক।” (মথি ১৬:২৪) যিশুকে অনুসরণ করা বুদ্ধিমানের কাজ এবং সঠিক, তবে এটা করা সহজ নয়।

১১. কীভাবে সোরের ভাই-বোনেরা পৌলের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছিল এবং চেয়েছিল পৌল যেন ভালোভাবে প্রচার কাজ চালিয়ে যান?

১১ অবশেষে সেই দিন আসে, যখন পৌল, লূক এবং বাকি সঙ্গীদের সোর ছেড়ে তাদের যাত্রার উদ্দেশে রওনা দিতে হবে। সোরের ভাইয়েরা পৌল এবং তার সঙ্গীদের ছাড়তে সমুদ্রের তীর পর্যন্ত যায়। তাদের মধ্যে মহিলা ও সন্তানেরাও রয়েছে। তারা সবাই একসঙ্গে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করে, এরপর পৌল এবং তার সঙ্গীদের বিদায় জানায়। এই দৃশ্যটা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এটা থেকে বোঝা যায় যে, তারা পৌলকে কতটা ভালোবাসে এবং তারা চায়, তিনি যেন ভালোভাবে প্রচার কাজ চালিয়ে যান। এরপর পৌল, লূক এবং বাকি সঙ্গীরা একটা জাহাজে করে তলিমায়িতে যায়। তারা সেখানকার ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করে এবং সেখানে এক দিন থেকে যান।—প্রেরিত ২১:৫-৭.

১২, ১৩. (ক) কীভাবে ফিলিপ ঈশ্বরের সেবায় এক চমৎকার উদাহরণ রেখেছিলেন? (খ) বর্তমানে খ্রিস্টান বাবারা ফিলিপের কাছ থেকে কী শিখতে পারে?

১২ লূক বলেন, এরপর পৌল এবং তার সঙ্গীরা কৈসরিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন, সেখানে পৌঁছে তারা “সুসমাচার প্রচারক ফিলিপের বাড়িতে” যান। a (প্রেরিত ২১:৮) ফিলিপের সঙ্গে দেখা করে তারা নিশ্চয়ই অনেক খুশি হয়েছিলেন। প্রায় ২০ বছর আগে, জেরুসালেমে যখন নতুন মণ্ডলী গঠিত হয়েছিল, তখন প্রেরিতেরা ফিলিপকে খাবার পরিবেশন করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ফিলিপ অনেক বছর ধরে উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার করছিলেন। আপনার হয়তো মনে আছে, জেরুসালেমে যখন শিষ্যদের উপর তাড়না করা হয়েছিল, তখন তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় ফিলিপ শমরিয়ায় চলে যান এবং সেখানে প্রচার করতে থাকেন। এরপর, তিনি ইথিওপিয়ার নপুংসকের কাছে প্রচার করেন এবং তাকে বাপ্তিস্ম দেন। (প্রেরিত ৬:২-৬; ৮:৪-১৩, ২৬-৩৮) ফিলিপ বছরের পর বছর ধরে মনপ্রাণ দিয়ে ঈশ্বরের সেবা করেছিলেন।

১৩ ফিলিপ কৈসরিয়াতে এখনও উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার করে চলেছেন। এই কারণেই লূক তাকে “সুসমাচার প্রচারক ফিলিপ” বলেছিলেন। শুধু তাই নয়, লূকের বিবরণ থেকে এও জানা যায় যে, তার চার জন অবিবাহিত মেয়ে ছিল, যারা ভবিষ্যদ্‌বাণী করতেন। তারা নিশ্চয়ই তাদের বাবা ফিলিপের উদাহরণ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন। b (প্রেরিত ২১:৯) ফিলিপ নিশ্চয়ই কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন, যে-কারণে তার পুরো পরিবার যিহোবাকে ভালোবাসত এবং তার সেবা করত। বর্তমানেও বাবারা কীভাবে ফিলিপের মতো হওয়ার চেষ্টা করতে পারে? তারা নিজেরা প্রচার কাজে পরিশ্রম করবে এবং সন্তানদের প্রচার কাজের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করবে।

১৪. পৌল এবং তার সঙ্গীরা যখন ভাই-বোনদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন, তখন কোন উপকার হয়েছিল এবং বর্তমানে আমাদের কাছে কোন সুযোগ রয়েছে?

১৪ পৌল তার যাত্রার সময়ে যেখানেই যেতেন, সেখানেই খ্রিস্টান ভাই-বোনদের খুঁজতেন, যেন তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন। সেই ভাই-বোনেরাও পৌল এবং তার সঙ্গীদের আতিথেয়তা দেখিয়ে নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছিল। এভাবে একসঙ্গে সময় কাটানোর মাধ্যমে তারা নিশ্চয়ই “পরস্পরকে উৎসাহিত” করেছিল। (রোমীয় ১:১১, ১২) বর্তমানে, আমাদের কাছেও এমন অনেক সুযোগ আসে, যখন আমরা অন্যদের আতিথেয়তা দেখাতে পারি। আমাদের ঘর হয়তো অনেক বড়ো নয়, তা সত্ত্বেও আমরা যদি সীমা অধ্যক্ষ এবং তার স্ত্রীকে আমাদের ঘরে আমন্ত্রণ জানাই, তা হলে আমরা নিশ্চয়ই অনেক উৎসাহিত হব।—রোমীয় ১২:১৩.

“আমি . . . মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত আছি” (প্রেরিত ২১:১০-১৪)

১৫, ১৬. আগাব কোন বার্তা নিয়ে এসেছিলেন এবং তার বার্তা শুনে ভাইয়েরা কী করেছিল?

১৫ পৌল যখন ফিলিপের বাড়িতে ছিলেন, তখন সেখানে আরেক জন অতিথি আসেন, যিনি খ্রিস্টানদের মধ্যে বেশ সুপরিচিত ছিলেন। তার নাম ছিল আগাব। ফিলিপের ঘরে থাকা সবাই জানত যে, তিনি একজন ভাববাদী। তিনি সম্রাট ক্লৌদিয়ের সময়ে ভবিষ্যদ্‌বাণী করেছিলেন যে, এক ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হবে আর সেটাই হয়েছিল। (প্রেরিত ১১:২৭, ২৮) তাই, সবার মনে হয়তো এই প্রশ্ন আসছিল যে, ‘আগাব এখানে কেন এসেছেন? তিনি আমাদের কোন বার্তা জানাতে চান?’ সবার নজর যখন আগাবের উপর, তখন আগাব পৌলের কাছ থেকে তার কোমরবন্ধনী নিয়ে নিজের হাত-পা বাঁধলেন। এই কোমরবন্ধনী একটা বড়ো কাপড়, যেটা দিয়ে লোকেরা নিজেদের কোমর বাঁধত এবং তার মধ্যে টাকাপয়সা আর সেইসঙ্গে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস রাখত। কোমরবন্ধনী দিয়ে নিজের হাত-পা বাঁধার পর আগাব বলতে শুরু করেন। তার বার্তা বেশ গুরুগম্ভীর ছিল। তিনি বলেন: “পবিত্র শক্তি এই কথা বলেছে, ‘এই কোমরবন্ধনী যার, তাকে জেরুসালেমের যিহুদিরা এইভাবে বাঁধবে এবং তাকে ন-যিহুদিদের হাতে তুলে দেবে।’”—প্রেরিত ২১:১১.

১৬ এই ভবিষ্যদ্‌বাণী থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, পৌল অবশ্যই জেরুসালেমে যাবেন। এর থেকে এটাও বোঝা যায় যে, জেরুসালেমের যিহুদিরা “তাকে ন-যিহুদিদের হাতে তুলে দেবে।” সেখানে উপস্থিত ভাই-বোনেরা যখন শোনে যে, পৌলের প্রতি কী ঘটতে চলেছে, তখন তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। লূক বলেন: “এই কথা শুনে আমরা এবং সেখানে উপস্থিত সকলে তাকে অনুরোধ করতে লাগলাম, যেন তিনি জেরুসালেমে না যান। তখন পৌল বললেন: ‘কেন তোমরা কান্নাকাটি করে আমার সংকল্পকে দুর্বল করে দিচ্ছ? জেনে রাখ, আমি প্রভু যিশুর নামে জেরুসালেমে কেবল বন্দি হতেই নয়, এমনকী মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত আছি।’”—প্রেরিত ২১:১২, ১৩.

১৭, ১৮. কীভাবে পৌল দেখিয়েছিলেন যে, তিনি তার সিদ্ধান্তে দৃঢ় ছিলেন আর সেই সময়ে ভাইয়েরা কী করেছিল?

১৭ একটু কল্পনা করুন, ফিলিপের ঘরে একত্রিত হওয়া ভাইয়েরা পৌলের কাছে অনুরোধ করে, যেন তিনি জেরুসালেমে না যান। লূকও তাকে একই কথা বলেন আর কেউ কেউ তো কান্নাকাটি করতে থাকে। পৌল লক্ষ করেন, তারা সবাই তাকে কতটা ভালোবাসে আর তার জন্য কতই-না চিন্তা করে! কিন্তু, তিনি প্রেমের সঙ্গে তাদের বোঝান যে, তারা যেন তাদের কথার মাধ্যমে তার “সংকল্পকে দুর্বল করে” না দেয়। পৌল তার সংকল্পে দৃঢ় যে, তিনি জেরুসালেম যাবেন। তিনি সোরের ভাইদের কথায় তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি আর এখন এই ভাইদের কথাতেও তিনি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি। এর পরিবর্তে, তিনি তাদের বোঝান যে, জেরুসালেমে যাওয়া তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সত্যিই, পৌল অনেক সাহসী ছিলেন! যিশুর মতো পৌলও পিছপা হওয়ার মত ব্যক্তি নন, তিনি জেরুসালেমে যাবেনই। (ইব্রীয় ১২:২) এর মানে এই নয় যে, পৌলের মারা যাওয়ার শখ ছিল। কিন্তু, খ্রিস্ট যিশুর জন্য তিনি মৃত্যুবরণ করতেও রাজি ছিলেন এবং এটাকে সম্মানের বিষয় বলে মনে করতেন।

১৮ এখন ভাইয়েরা কী করবে? অল্প কথায় বললে, তারা পৌলের সিদ্ধান্তকে সম্মান করে। বিবরণ বলে: “আমরা যখন বুঝতে পারলাম, আমরা তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারব না, তখন আমরা আর তাকে জোর করলাম না এবং তাকে বললাম: ‘যিহোবার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।’” (প্রেরিত ২১:১৪) ভাইয়েরা পৌলকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঠিকই, কিন্তু তারা জোরাজুরি করেনি। যদিও তাদের পক্ষে পৌলের কথা মেনে নেওয়া সহজ ছিল না, তা সত্ত্বেও তারা তার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। তারা এই বিষয়টা বুঝতে পারে যে, এটা যিহোবারই ইচ্ছা। পৌল এমন এক পথ বেছে নিয়েছেন, যা মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। তাই, ভাই-বোনেরা যদি পৌলের সংকল্প দুর্বল করে না দেয়, তা হলে পৌলের পক্ষে তার সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকা সহজ হবে।

১৯. পৌলের প্রতি যা ঘটেছিল সেখান থেকে আমরা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখতে পারি?

১৯ এই ঘটনা থেকে আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখি। আমাদের কখনোই সেই ভাই-বোনদের সংকল্প দুর্বল করে দেওয়া উচিত নয়, যারা ঈশ্বরের সেবায় অনেক ত্যাগস্বীকার করে। এই শিক্ষাকে আমরা শুধুমাত্র জীবন ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে নয় বরং অন্যান্য পরিস্থিতিতেও কাজে লাগাতে পারি। সেই সমস্ত বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করুন, যাদের সন্তানেরা যিহোবার সেবা করার জন্য তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে যায়। নিজের সন্তানের থেকে দূরে থাকা সেই বাবা-মায়ের জন্য সহজ বিষয় নয়, তা সত্ত্বেও তারা সন্তানদের এমন কিছু বলে না, যাতে তাদের সংকল্প দুর্বল হয়ে যায়। ইংল্যান্ডে বসবাসকারী বোন ফিলিসের উদাহরণ লক্ষ করুন। তার একমাত্র মেয়ে যখন তাকে ছেড়ে আফ্রিকায় একজন মিশনারি হিসেবে সেবা করার জন্য গিয়েছিল, তখন তার মনের অবস্থা সম্বন্ধে তিনি বলেন, “আমি খুশি ছিলাম, সে যিহোবার সেবা করার জন্য যাচ্ছে, কিন্তু এই চিন্তা করে দুঃখও পাচ্ছিলাম যে, সে আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। এই বিষয়ে আমি অনেক প্রার্থনা করি, যেন আমি সঠিক মনোভাব রাখতে পারি। যেহেতু এটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, তাই আমি তা পরিবর্তন করার চেষ্টা করিনি। কারণ আমিই তো তাকে শিখিয়েছিলাম, সে যেন যিহোবার সেবাকে জীবনে প্রথম স্থান দেয়! এখন সে ৩০ বছর ধরে অন্য দেশে সেবা করছে। আমি প্রতিদিন যিহোবাকে ধন্যবাদ দিই যে, আমার মেয়ে এখনও পর্যন্ত তাঁর সেবা করে চলেছে।” এমন আরও অনেক ভাই-বোনেরা রয়েছে, যারা যিহোবার সেবায় অনেক বড়ো বড়ো ত্যাগ স্বীকার করেছে। আসুন, আমরা তাদের উৎসাহিত করি, যেন তারা যিহোবার সেবা চালিয়ে যেতে পারে।

আমাদের সেইসমস্ত ভাই-বোনদের উৎসাহিত করতে হবে, যারা যিহোবার সেবা করার জন্য ত্যাগস্বীকার করে

“ভাইয়েরা আনন্দের সঙ্গে আমাদের স্বাগত জানালেন” (প্রেরিত ২১:১৫-১৭)

২০, ২১. কী দেখায় যে, পৌল সব সময় তার ভাইদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন আর এর ফলাফল কী হয়েছিল?

২০ আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, পৌল এবং তার সঙ্গীরা যাত্রার সময় যেখানেই গিয়েছিলেন, সেখানেই খ্রিস্টীয় ভাই-বোনদের খুঁজে বের করেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন। যেমন, সোরে ভাইদের সঙ্গে সাত দিন, তলিমায়িতে ভাই-বোনদের সঙ্গে এক দিন এবং কৈসরিয়াতে ফিলিপের ঘরে কিছু দিন থাকেন। এখন পৌল জেরুসালেমে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। কৈসরিয়ার কিছু ভাইও তার সঙ্গে যায়। এই ভাইদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে পৌল নিশ্চয়ই অনেক শক্তিশালী হয়েছিলেন। জেরুসালেমে পৌঁছে তিনি ম্নাসোনের বাড়িতে থাকেন, যিনি প্রথম দিকের শিষ্যদের মধ্যে একজন ছিলেন। এই বিষয়ে লূক লেখেন: “আমরা জেরুসালেমে পৌঁছানোর পর, ভাইয়েরা আনন্দের সঙ্গে আমাদের স্বাগত জানালেন।”—প্রেরিত ২১:১৭.

২১ এই পুরো বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি, পৌল সব সময় ভাই-বোনদের সাথে সময় কাটাতে চাইতেন। তাই, তিনি সেই ভাই-বোনদের কাছ থেকে অনেক উৎসাহিত হয়েছিলেন, যেমনটা বর্তমানে আমরাও হই। শুধু তাই নয়, পরবর্তী সময়ে পৌল সেই ভয়ংকর শত্রুদের মুখোমুখি হওয়ার জন্যও অনেক সাহস পেয়েছিলেন, যারা তার পিছনে পড়েছিল।