সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় ১৬

‘ম্যাসিডোনিয়ায় আসুন’

‘ম্যাসিডোনিয়ায় আসুন’

যিহোবার দেওয়া যেকোনো কাজ গ্রহণ করলে এবং তাড়নার মধ্যেও আনন্দ বজায় রাখলে, আশীর্বাদ লাভ করা যায়

প্রেরিত ১৬:৬-৪০ পদের উপর ভিত্তি করে

১-৩. (ক) কীভাবে পবিত্র শক্তি পৌল এবং তার সঙ্গীদের নির্দেশনা দিয়েছিল? (খ) আমরা কোন ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা করব?

 ম্যাসিডোনিয়ার ফিলিপী নগরের একদল মহিলা যেতে যেতে নগর থেকে একটু দূরে গাংগিটিস নদীর কাছে এসে পৌঁছায়। প্রতি বারের মতো তারা নদীর ধারে বসে ইজরায়েলের ঈশ্বর যিহোবার কাছে প্রার্থনা করতে থাকে। যিহোবা তাদের লক্ষ করেন এবং তাদের প্রার্থনা শোনেন।—২ বংশা. ১৬:৯; গীত. ৬৫:২.

সেই একই সময়ে পৌল, সীল ও তীমথিয় ফিলিপী থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব দিকে গালাতিয়া অঞ্চলের লুস্ত্রা নগর থেকে এগিয়ে চলেছেন আর দিনের শেষে তারা সেই নগর থেকে বেরিয়ে রোমীয় সড়ক পথে এসে পৌঁছান। এই পথ এশিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতি এলাকার দিকে নিয়ে যায়। তারা সেই রাস্তা ধরে ইফিষ এবং অন্যান্য নগরে যেতে চান, যাতে তারা সেখানে থাকা হাজার হাজার লোকদের কাছে খ্রিস্ট সম্বন্ধে সুসমাচার জানাতে পারেন। তবে, তাদের যাত্রা শুরু করার আগেই পবিত্র শক্তি তাদের বাধা দেয়। বাইবেল যদিও জানায় না, পবিত্র শক্তি কীভাবে তাদের বাধা দিয়েছিল, তবে এশিয়া প্রদেশে তাদের প্রচার করতে বারণ করা হয়। কিন্তু কেন? কারণ যিশু চান যেন পৌল এবং তার সঙ্গীরা এশিয়া প্রদেশ থেকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ঈজিয়ান সাগর পার করে ফিলিপী নগরের বাইরে গাংগিটিস নদীর তীরে যান।

ম্যাসিডোনিয়ায় যাওয়ার জন্য যিশু যেভাবে পৌল এবং তার সঙ্গীদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেখান থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় শিখতে পারি। তাই আসুন, আমরা পৌলের দ্বিতীয় মিশনারি যাত্রার কিছু ঘটনার প্রতি মনোযোগ দিই, যে-যাত্রা তিনি প্রায় ৪৯ সালে শুরু করেছিলেন।

“ঈশ্বর আমাদের ডেকেছেন” (প্রেরিত ১৬:৬-১৫)

৪, ৫. (ক) পৌল এবং তার সঙ্গীরা যখন প্রায় বিথুনিয়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, তখন কী ঘটেছিল? (খ) তারা কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর এর ফলাফল কী হয়েছিল?

পৌল এবং তার সঙ্গীদের যখন এশিয়ায় প্রচার করতে বাধা দেওয়া হয়, তখন তারা উত্তর দিকে এগিয়ে যান। তারা বিথুনিয়া প্রদেশের নগরগুলোতে গিয়ে প্রচার করতে চান। বিথুনিয়ায় পৌঁছানোর জন্য তারা ফরুগিয়া ও গালাতিয়া অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যান, যেখানে খুব কম লোক বাস করে। সেখানকার কাঁচা রাস্তা দিয়ে তাদের বেশ কয়েক দিন পায়ে হেঁটে যাত্রা করতে হয়। তারা যখন প্রায় বিথুনিয়ায় পৌঁছে গিয়েছে, এমন সময় যিশু পবিত্র শক্তির মাধ্যমে তাদের বলেন যে, তারা বিথুনিয়াতেও প্রচার করতে পারবেন না। (প্রেরিত ১৬:৬, ৭) এখন তারা চিন্তায় পড়ে যান। তারা এটা তো জানেন লোকদের কাছে কী প্রচার করতে হবে এবং কীভাবে প্রচার করতে হবে, কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারছেন না যে, তাদের কোথায় প্রচার করতে হবে। প্রথমে, তারা এশিয়াতে প্রচার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। পরে, তারা বিথুনিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু যিশু তাদের বাধা দেন। বিষয়টা এমন ছিল, যেন তারা একটা দরজায় কড়া নাড়েন, কিন্তু সেই দরজা খোলা হয় না। পরে দ্বিতীয় দরজায় কড়া নাড়েন, কিন্তু সেটাও খোলা হয় না। তবে, পৌল হাল ছেড়ে না দিয়ে বরং এই বিষয়ে দৃঢ় ছিলেন যে, তিনি ততক্ষণ দরজায় কড়া নেড়ে যাবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা খোলা হয়। এরপর পৌল এবং তার সঙ্গীরা এমন একটা সিদ্ধান্ত নেন যেটা অন্যদের কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হতে পারে। তারা বিথুনিয়া থেকে পশ্চিম দিকে নগরগুলোর মধ্য দিয়ে ৫৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেন। অবশেষে তারা ত্রোয়া বন্দরে এসে পৌঁছান, যেখান থেকে ম্যাসিডোনিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করতে পারবেন। (প্রেরিত ১৬:৮) এখন পৌল তৃতীয় বার দরজায় কড়া নাড়েন আর এই বার তার জন্য দরজা খুলে যায়।

পৌল এবং তার সঙ্গীরা যখন ত্রোয়াতে এসে পৌঁছান, তখন লূকও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর কী হয়েছিল লূক তা লেখেন: “রাতের বেলা পৌল একটা দর্শন দেখলেন—ম্যাসিডোনিয়ার একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তাকে এই অনুরোধ করছে: ‘ম্যাসিডোনিয়ায় এসে আমাদের সাহায্য করুন।’ তিনি এই দর্শন দেখার পর আমরা সঙ্গেসঙ্গে ম্যাসিডোনিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করলাম, কারণ আমরা বুঝতে পারলাম, সেখানকার লোকদের কাছে সুসমাচার ঘোষণা করার জন্য ঈশ্বর আমাদের ডেকেছেন।” a (প্রেরিত ১৬:৯, ১০) অবশেষে পৌল বুঝতে পারেন, তাকে কোথায় প্রচার করতে হবে। পৌল কতই-না খুশি হয়েছিলেন কারণ তিনি হাল ছেড়ে দেননি! এরপর, সেই চার জন ভাই ত্রোয়া থেকে ম্যাসিডোনিয়ায় যাওয়ার জন্য দ্রুত জাহাজে উঠে পড়েন।

“তখন আমরা ত্রোয়া থেকে সমুদ্রপথে . . . গেলাম”—প্রেরিত ১৬:১১

৬, ৭. (ক) পৌলের বিবরণ থেকে আমরা কী শিখি? (খ) আমাদের সামনেও বাধা এলে পৌলের মতো আমরা কী করতে পারি?

এই বিবরণ থেকে আমরা কী শিখি? লক্ষ করুন, পৌল যখন এশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন, তখন পবিত্র শক্তি তাকে নির্দেশনা দেয়। পৌল যখন বিথুনিয়ার কাছাকাছি পৌঁছান, তখন যিশু তাকে নির্দেশনা দেন। আর পৌল যখন ত্রোয়াতে পৌঁছান, তখন যিশু তাকে ম্যাসিডোনিয়ায় যাওয়ার কথা বলেন। মণ্ডলীর মস্তক হিসেবে যিশু বর্তমানেও আমাদের একইভাবে নির্দেশনা দেন। (কল. ১:১৮) উদাহরণ স্বরূপ, আমরা হয়তো অনেক দিন ধরে অগ্রগামী হিসেবে কাজ করার কথা চিন্তা করছি কিংবা এমন জায়গায় গিয়ে প্রচার করার কথা চিন্তা করছি, যেখানে প্রকাশকদের বেশি প্রয়োজন। কিন্তু, শুধুমাত্র চিন্তা করাই যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কিছু পদক্ষেপও নিতে হবে। আর তখনই যিশু আমাদের পবিত্র শক্তির মাধ্যমে সঠিক নির্দেশনা দেবেন। কেন আমরা তা বলতে পারি? এই উদাহরণটা নিয়ে চিন্তা করুন। একজন চালক তার গাড়িকে তখনই ডান দিকে কিংবা বাঁ-দিকে ঘোরাতে পারে, যখন সেই গাড়িটা চলতে থাকে। একইভাবে, যিশু আমাদের তখনই আরও বেশি করে প্রচার করতে সাহায্য করবেন, যখন আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেব।

কিন্তু, আমরা যদি দ্রুত সফলতা না পাই, তা হলে? আমাদের কি এইরকম চিন্তা করা উচিত যে, পবিত্র শক্তি আমাদের নির্দেশনা দিচ্ছে না? কখনোই না। মনে করে দেখুন, পৌলের সামনেও বাধা এসেছিল। কিন্তু, তিনি হাল ছেড়ে দেননি বরং তিনি ততক্ষণ দরজায় কড়া নেড়েছিলেন, যতক্ষণ না তার জন্য দরজা খোলা হয়েছিল। আমরাও যদি হাল ছেড়ে না দিই, তা হলে যিহোবা আমাদের জন্যও সুযোগের “এক বড়ো দরজা খুলে” দেবেন।—১ করি. ১৬:৯.

৮. (ক) ফিলিপী নগরটা কেমন ছিল বর্ণনা করুন। (খ) পৌল যখন ‘প্রার্থনাস্থানে’ প্রচার করেন, তখন তার ফলাফল কী হয়েছিল?

ম্যাসিডোনিয়ায় পৌঁছানোর পর পৌল এবং তার সঙ্গীরা ফিলিপী নগরে যান। রোমীয় নাগরিক হওয়ায় এখানকার লোকদের অনেক অহংকার ছিল। ফিলিপী নগরটা রোমের মতোই ছিল আর সেখানে অবসরপ্রাপ্ত অনেক রোমীয় সৈন্য থাকত। পৌল এবং তার সঙ্গীরা নগরদ্বারের বাইরে নদীর কাছে “প্রার্থনাস্থান” খুঁজে পান। b বিশ্রামবারে তারা সেই জায়গায় পৌঁছান আর দেখেন যে, সেখানে অনেক মহিলা ঈশ্বরের উপাসনা করার জন্য একত্রিত হয়েছে। এই ভাইয়েরা সেখানেই বসে তাদের কাছে প্রচার করতে শুরু করেন। সেই মহিলাদের মধ্যে লুদিয়া নামে একজন মহিলা ছিলেন। তিনি সেই ভাইদের কথা মন দিয়ে শুনছিলেন আর তখন “যিহোবা তার হৃদয় পুরোপুরি খুলে দিলেন।” তাদের কথাগুলো লুদিয়ার উপর এতটাই প্রভাব ফেলে যে, তিনি এবং তার পরিবার বাপ্তিস্ম নিয়ে নেন। এরপর লুদিয়া, পৌল এবং তার সঙ্গীদের যেকোনো প্রকারে রাজি করিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। cপ্রেরিত ১৬:১৩-১৫.

৯. বর্তমানে অনেকেই পৌলের মতো কী করে এবং তারা কোন আশীর্বাদ লাভ করে?

লুদিয়াকে বাপ্তিস্ম নিতে দেখে পৌল এবং তার সঙ্গীরা কতই-না আনন্দিত হয়েছিলেন! পৌল হয়তো চিন্তা করছিলেন, “ম্যাসিডোনিয়ায় এসে” তিনি কতই-না ভালো কাজ করেছেন! তিনি হয়তো এই জন্যও খুশি হয়েছিলেন যে, যিহোবা তাকে এবং তার সঙ্গীদের লুদিয়ার মতো মহিলাদের সাহায্য করার জন্য যোগ্য বলে মনে করেছিলেন। বর্তমানে এমন অনেক অল্পবয়সি, বয়স্ক, অবিবাহিত ও বিবাহিত ভাই-বোনও রয়েছে, যারা যেখানে বেশি প্রয়োজন, সেখানে গিয়ে সেবা করছে। হতে পারে, তাদের বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তবে, তারা যখন প্রচারে লুদিয়ার মতো লোকদের খুঁজে পায়, তখন তারা সেই সমস্ত সমস্যা ভুলে যায়। আপনিও যদি এমন কোনো এলাকায় গিয়ে সেবা করেন, তা হলে আপনিও অনেক আশীর্বাদ লাভ করবেন। অ্যারন নামে একজন যুবক ভাইয়ের কথা চিন্তা করুন, যিনি মধ্য আমেরিকার এক শহরে প্রচার করার জন্য যান। তিনি বলেন: “এখানে এসে প্রচার করার ফলে ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছে। আর আমি নিজেকে ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী অনুভব করি। প্রচার কাজ করতে আমার খুব ভালো লাগে আর আমি আট জনকে বাইবেল অধ্যয়ন করাই।” অ্যারনের মতো অনেক ভাই-বোনও একইরকম অনুভব করে।

“ম্যাসিডোনিয়ায় এসে আমাদের সাহায্য করুন।” বর্তমানে কীভাবে আমরা তা করতে পারি?

‘জনতা তাদের বিরুদ্ধে যোগ দিল’ (প্রেরিত ১৬:১৬-২৪)

১০. কীভাবে শয়তান আর তার মন্দ স্বর্গদূতেরা পৌল এবং তার সঙ্গীদের সামনে বাধা নিয়ে এসেছিল?

১০ ফিলিপী নগরের উপর শয়তান আর তার মন্দ স্বর্গদূতদের বেশ প্রভাব রয়েছে। তাই, লোকদের খ্রিস্টান হতে দেখে শয়তান রেগে লাল হয়ে যায়। এখন সে আর তার মন্দ স্বর্গদূতেরা নিশ্চয়ই পৌল এবং তার সঙ্গীদের সামনে বাধা নিয়ে আসবে। একবার যখন পৌল এবং তার সঙ্গীরা প্রার্থনাস্থানে যাচ্ছিলেন, তখন এক দাসী তাদের পিছন পিছন যেতে থাকে। সেই দাসীকে মন্দ স্বর্গদূত ধরেছিল আর তাই সে ভাগ্য গণনা করতে পারত। এর ফলে, তার প্রভুরা অনেক টাকাপয়সা আয় করত। সেই দাসী পৌল এবং তার সঙ্গীদের পিছন পিছন আসতে থাকে এবং চিৎকার করে বলে: “এই লোকেরা পরমেশ্বরের দাস, এরা তোমাদের কাছে পরিত্রাণের পথ সম্বন্ধে প্রচার করছে।” সেই দাসীর মধ্যে যে-মন্দ স্বর্গদূত ছিল, সেই হয়তো এই কথাগুলো বলাচ্ছিল, যাতে লোকেরা এমনটা মনে করে এই মেয়েটিও যিহোবার পক্ষ থেকে কথা বলছে। এর ফলে, লোকদের মনোযোগ সেই সুসমাচারের উপর থেকে সরে যেতে পারত, যা পৌল শোনাচ্ছিলেন। তাই, পৌল সেই মেয়েটির মধ্য থেকে দুষ্ট স্বর্গদূতকে বের করে দেন আর সেই মেয়েটি চুপ হয়ে যায়।—প্রেরিত ১৬:১৬-১৮.

১১. সেই দাসীর মধ্য থেকে মন্দ স্বর্গদূতকে বের করে দেওয়ার পর পৌল ও সীলের প্রতি কী ঘটেছিল?

১১ সেই দাসীর প্রভুরা যখন দেখে যে, তাদের ব্যাবসা লাটে উঠে গিয়েছে, তখন তাদের মাথা গরম হয়ে যায়। তারা পৌল ও সীলকে ধরে টানতে টানতে বাজারে নগরাধ্যক্ষদের কাছে নিয়ে যায়। এই নগরাধ্যক্ষেরা রোমীয় সরকারের পক্ষ থেকে আদালত বসাতেন এবং লোকদের সমস্যার সমাধান করতেন। রোমীয় হওয়ায় এই নগরাধ্যক্ষেরা খুবই গর্বিত ছিলেন এবং যিহুদিদের ঘৃণা করতেন আর এই বিষয়টা সেই দাসীর প্রভুরাও জানত। তাই, তারা নগরাধ্যক্ষদের কাছে বলে: “এই লোকেরা আমাদের নগরকে অত্যন্ত অশান্ত করে তুলেছে। এরা যিহুদি, এরা এমন রীতিনীতির বিষয়ে প্রচার করছে, যেগুলো রোমীয় হিসেবে আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা কিংবা পালন করা বৈধ নয়।” তারপর আর কি! বাজারে “জনতাও পৌল ও সীলের বিরুদ্ধে তাদের সঙ্গে যোগ দিল।” আর নগরাধ্যক্ষেরা “তাদের বেত দিয়ে প্রহার করার আদেশ দিলেন।” এরপর, পৌল ও সীলকে কারাগারে বন্দি করা হয়। কারারক্ষী তাদের কারাগারের ভিতরের কক্ষে রাখল এবং হাড়িকাঠ দিয়ে তাদের পা আটকে দিল। (প্রেরিত ১৬:১৯-২৪) কারারক্ষী যখন দরজা বন্ধ করে দেয়, তখন কারাগারের ভিতরে এতটাই অন্ধকার হয়ে যায় যে, পৌল ও সীল একে অন্যকে আর দেখতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু, যিহোবা তাদের দেখতে পাচ্ছিলেন আর তাদের কষ্টও অনুভব করতে পারছিলেন।—গীত. ১৩৯:১২.

১২. (ক) যিশুর শিষ্যেরা তাড়না সম্বন্ধে কী জানত এবং কেন? (খ) বর্তমানেও শয়তান কিছু লোককে কাজে লাগিয়ে কোন কৌশল ব্যবহার করে?

১২ কিছু বছর আগে, যিশু তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, “তারা তোমাদেরও তাড়না করবে।” (যোহন ১৫:২০) তাই, পৌল এবং তার সঙ্গীরা যখন ম্যাসিডোনিয়ায় গিয়েছিলেন, তখন তারা তাড়নার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তাদের উপর যখন তাড়না করা হয়েছিল, তখন তারা এমনটা মনে করেননি যে, যিহোবা তাদের উপর রেগে আছেন। এর পরিবর্তে, তারা এটা বুঝেছিলেন, শয়তান তাদের উপর নিজের রাগ মেটাচ্ছে। বর্তমানেও, শয়তান কিছু লোককে কাজে লাগিয়ে একইরকম কৌশল ব্যবহার করে, যেমনটা সে ফিলিপীতে করেছিল। যেমন, স্কুলে কিংবা কাজের জায়গায় এমন কেউ কেউ থাকে, যারা আমাদের সম্বন্ধে মিথ্যা রটায় এবং আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের উসকে দেয়। কোনো কোনো দেশে বিরোধীরা আমাদের আদালতেও নিয়ে যায়। তারা আমাদের উপর এই মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে আসে যে, ‘যিহোবার সাক্ষিরা লোকদের ভুল বিষয়গুলো শেখায় আর যে-রীতিনীতি আমরা বংশপরম্পরায় পালন করে এসেছি, সাক্ষিরা সেই সমস্ত ছেড়ে দিতে বলে।’ কোনো কোনো দেশে ভাই-বোনদের মারধর করা হয় এবং কারাগারে বন্দি করা হয়। কিন্তু, আমাদের সঙ্গে যে-অবিচারগুলো ঘটছে, সেই সমস্ত কিছু যিহোবা দেখছেন।—১ পিতর ৩:১২.

“অবিলম্বে বাপ্তিস্ম নিল” (প্রেরিত ১৬:২৫-৩৪)

১৩. এমন কী ঘটেছিল যে-কারণে কারারক্ষী বলেছিল: “রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাকে কী করতে হবে?”

১৩ সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পৌল ও সীলের কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু, প্রায় মাঝ রাতে তারা ‘প্রার্থনা করেন এবং ঈশ্বরের উদ্দেশে প্রশংসাগান করেন।’ তখন হঠাৎই ভূমিকম্প হয় আর কারাগারের ভিত পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। কারারক্ষী জেগে উঠে দেখে কারাগারের দরজাগুলো খোলা। তখন সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে মনে করে সমস্ত বন্দি পালিয়ে গিয়েছে। সে জানত বন্দিরা যদি পালিয়ে যায়, তা হলে অবশ্যই তার শাস্তি হবে। তাই, সে যখন ‘নিজের খড়্গ বের করে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে,’ এমন সময় পৌল জোরে চিৎকার করে বললেন, “এমনটা কোরো না, কারণ আমরা সবাই এখানেই আছি!” কারারক্ষী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পৌল ও সীলের কাছে আসে এবং জিজ্ঞেস করে “রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাকে কী করতে হবে?” পৌল ও সীল জানতেন যে, সেই কারারক্ষীকে তারা নয় বরং যিশু রক্ষা করতে পারেন। সেইজন্য তারা বলেন: “প্রভু যিশুর উপর বিশ্বাস করো, তা হলে তুমি এবং তোমার পরিবার ও পরিজন রক্ষা পাবে।”—প্রেরিত ১৬:২৫-৩১.

১৪. (ক) কীভাবে পৌল ও সীল কারারক্ষীকে সাহায্য করেছিলেন? (খ) আনন্দের সঙ্গে তাড়না সহ্য করার ফলে তারা কোন আশীর্বাদ পেয়েছিলেন?

১৪ সেই কারারক্ষী কি সত্যি সত্যি জানার জন্য এই প্রশ্ন করেছিল? পৌল নিশ্চিত ছিলেন যে, কারারক্ষী সত্যি করেই জানতে চায়। সেই কারারক্ষী একজন ন-যিহুদি ছিল আর শাস্ত্রের বিষয়ে কিছুই জানত না। খ্রিস্টান হওয়ার জন্য তাকে শাস্ত্রের মৌলিক শিক্ষাগুলো শিখতে হত এবং সেগুলো বিশ্বাস করতে হত। তাই, পৌল ও সীল তার কাছে “যিহোবার বাক্য প্রচার করলেন।” তারা তাকে শেখাতে এতটাই মগ্ন হয়ে যান যে, নিজেদের সব কষ্ট ভুলে যান। কারারক্ষী যখন দেখে যে তাদের পিঠে ক্ষত রয়েছে, তখন সে তাদের ক্ষতস্থান ধুয়ে দেয়। এরপর, ‘সে এবং তার সমস্ত পরিবার ও পরিজন অবিলম্বে বাপ্তিস্ম নেয়।’ পৌল ও সীল আনন্দের সঙ্গে তাড়না সহ্য করেছিলেন বলে কতই-না বড়ো এক আশীর্বাদ পেয়েছিলেন!—প্রেরিত ১৬:৩২-৩৪.

১৫. (ক) বর্তমানে অনেক সাক্ষি পৌল ও সীলের মতো কী করে? (খ) কেন আমাদের বার বার লোকদের সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন?

১৫ বর্তমানেও, অনেক সাক্ষিকে তাদের বিশ্বাসের কারণে জেলে যেতে হয়। পৌল ও সীলের মতো তারাও জেলের মধ্যে সুসমাচার প্রচার করে আর ভালো ফলাফল পায়। উদাহরণ স্বরূপ, একটা দেশে যখন প্রচার কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তখন সেখানে থাকা সাক্ষিদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যক্তি জেলে থাকাকালীন সত্য সম্বন্ধে শেখে। (যিশা. ৫৪:১৭) লক্ষ করুন, ভূমিকম্পের পরেই সেই কারারক্ষী সুসমাচারের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিল। একইভাবে, বর্তমানেও কিছু লোকের জীবনে দুঃখজনক কিছু না ঘটা পর্যন্ত তারা সুসমাচারের প্রতি আগ্রহ দেখায় না। এই কারণেই আমরা লোকদের সঙ্গে বার বার দেখা করি, যাতে যখনই তারা শোনার জন্য আগ্রহ দেখাবে, তখনই আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি।

“আর এখন কিনা তারা গোপনে আমাদের বের করে দিতে চাইছেন?” (প্রেরিত ১৬:৩৫-৪০)

১৬. যে-দিন পৌল ও সীলকে প্রহার করা হয়, ঠিক তার পরের দিন কী ঘটেছিল?

১৬ যে-দিন পৌল ও সীলকে মারধর করা হয়, ঠিক তার পরের দিন সকালে নগরাধ্যক্ষেরা আদেশ দেন যেন তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু, পৌল বলেন: “আমরা রোমীয়, আমাদের বিচার না করেই তারা আমাদের প্রকাশ্যে প্রহার করিয়েছেন এবং কারাগারে ঢুকিয়েছেন। আর এখন কিনা তারা গোপনে আমাদের বের করে দিতে চাইছেন? এমনটা হবে না! তারা নিজেরা এসে যেন আমাদের বাইরে নিয়ে যান।” নগরাধ্যক্ষেরা যখন জানতে পারেন যে, পৌল ও সীল রোমীয় নাগরিক, তখন তারা “ভয় পেয়ে” যান। কারণ তারা রোমীয় আইন ভঙ্গ করেছেন। d আর এখন পরিস্থিতি উলটে যায়। যে-নগরাধ্যক্ষেরা পৌল ও সীলকে সবার সামনে প্রহার করিয়েছিলেন, এখন সেই নগরাধ্যক্ষদেরই সবার সামনে তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। নগরাধ্যক্ষেরা এসে পৌল ও সীলের কাছে অনুরোধ করেন, যেন তারা ফিলিপী নগর ছেড়ে চলে যান। তারা দু-জন তাদের কথা মেনে নেন, তবে ফিলিপী ছাড়ার আগে, তারা সেখানকার নতুন শিষ্যদের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাদের উৎসাহিত করেন। এরপর, তারা সেখান থেকে চলে যান।

১৭. পৌল ও সীলের উদাহরণ থেকে নতুন শিষ্যেরা কোন বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল?

১৭ পৌল ও সীল চাইলে প্রথমেই বলতে পারতেন যে, তারা রোমীয় নাগরিক আর প্রহারের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারতেন। (প্রেরিত ২২:২৫, ২৬) কিন্তু, তারা যদি এমনটা করতেন, তা হলে ফিলিপীতে থাকা শিষ্যেরা মনে করত, এই দুই ভাই সুসমাচারের জন্য তাড়না সহ্য করতে চান না। আর সেই শিষ্যদের কেমন লাগত, যারা রোমীয় নাগরিক ছিল না? তাদের বিশ্বাস দুর্বল হয়ে যেতে পারত কারণ তারা সেই সুরক্ষা পেত না, যা রোমীয় নাগরিকেরা পেত। সেইজন্য পৌল ও সীল মুখ বুজে সমস্ত তাড়না সহ্য করেছিলেন। তাদের এই উদাহরণ নতুন শিষ্যদের এটা বুঝতে সাহায্য করেছিল যে, তারাও তাড়নার সময় স্থির থাকতে পারবে। কিন্তু, কেন পৌল ও সীল পরে এটা জানিয়েছিলেন যে, তারা রোমীয় নাগরিক? যাতে নগরাধ্যক্ষেরা সকলের সামনে এটা স্বীকার করেন যে, তারা রোমীয় আইন ভঙ্গ করেছেন আর এর ফলে, তারা পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টানদের উপর তাড়না করার আগে দশ বার ভেবে দেখবেন। এভাবে ভবিষ্যতে খ্রিস্টানেরা আইনের পক্ষ থেকে কিছুটা সুরক্ষা লাভ করবে।

১৮. (ক) পৌলের মতো বর্তমানে খ্রিস্টান প্রাচীনেরা কী করেন? (খ) “সুসমাচারের পক্ষসমর্থন করার” আর “বৈধ অধিকার লাভ করার জন্য” আমরা কী করি?

১৮ বর্তমানে, প্রাচীনেরাও পৌলের মতো ভাই-বোনদের জন্য উত্তম উদাহরণ স্থাপন করেন। তারা যখন ভাই-বোনদের কিছু করতে বলেন, তখন নিজেরাও তা করে দেখান। পৌলের মতো আমরাও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিই যে, কখন ও কীভাবে আমরা আমাদের আইনের অধিকারকে ব্যবহার করব। প্রয়োজন পড়লে আমরা দেশের নিম্ন কিংবা উচ্চ আদালতে আর এমনকী আন্তর্জাতিক আদালতেও মামলা করি, যেন উপাসনা করার ক্ষেত্রে আমাদের যে-অধিকার রয়েছে, তা সুরক্ষিত রাখতে পারি। তবে, সরকারের আইনকে পরিবর্তন করার জন্য আমরা কোনো মামলা করি না বরং পৌল যেমন লিখেছিলেন, আমরা “সুসমাচারের পক্ষসমর্থন করার” আর “বৈধ অধিকার লাভ করার জন্য” মামলা করি। তিনি এই সমস্ত কথা ফিলিপীতে হওয়া ঘটনাগুলোর প্রায় দশ বছর পর লিখেছিলেন। (ফিলি. ১:৭) বর্তমানে, আমরা কোনো মামলাতে জয় লাভ করি কিংবা না করি, পৌল এবং তার সঙ্গীদের মতো আমরাও এই বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, পবিত্র শক্তি আমাদের “সুসমাচার ঘোষণা করার জন্য” যেখানে পাঠাবে, আমরা সেখানেই যাব।—প্রেরিত ১৬:১০.

a লূক—প্রেরিত বইয়ের লেখক” শিরোনামের বাক্সটা দেখুন।

b অবসরপ্রাপ্ত রোমীয় সৈনিকদের কারণে হয়তো যিহুদিদের ফিলিপী নগরে সমাজগৃহ তৈরি করার অনুমতি ছিল না। আবার এও হতে পারে, নগরে একটা সমাজগৃহ থাকার জন্য সেখানে কমপক্ষে দশ জন যিহুদি পুরুষের প্রয়োজন হত আর যেহেতু সেই নগরে দশ জনেরও কম যিহুদি পুরুষ ছিল, তাই সেখানে সমাজগৃহ তৈরি হয়নি।

c লুদিয়া—একজন বেগুনি রঙের কাপড় বিক্রেতা” শিরোনামের বাক্সটা দেখুন।

d কোনো রোমীয় নাগরিক অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হলে, রোমীয় আইন অনুযায়ী প্রথমে তার বিচার করা হত এবং তার অপরাধ প্রমাণিত হলে, তবেই তাকে শাস্তি দেওয়া হত। কোনো রোমীয় নাগরিককে বিচার ছাড়া সবার সামনে শাস্তি দেওয়া যেত না।