বিষণ্ণদের জন্য সান্ত্বনা
বিষণ্ণদের জন্য সান্ত্বনা
“সমস্ত সৃষ্টি এখন পর্য্যন্ত একসঙ্গে আর্ত্তস্বর করিতেছে, ও একসঙ্গে ব্যথা খাইতেছে।” (রোমীয় ৮:২২) মানবজাতির দুর্দশা চরমে পৌঁছেছিল, ১,৯০০ বছর পূর্বে যখন এটি লেখা হয়। অনেকে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল। তাই, খ্রীষ্টানদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল: “ক্ষীণসাহসদিগকে সান্ত্বনা কর।”—১ থিষলনীকীয় ৫:১৪.
বর্তমানে, মানবজাতি আরও বেশী দুর্দশাগ্রস্ত, এবং বেশীরভাগ মানুষ বিষণ্ণ। কিন্তু তা কি আমাদের আশ্চর্য করে? বাস্তবিকই নয়, কারণ বাইবেল এইগুলিকে “শেষকাল” বলে চিহ্নিত করে এবং বলে এটি “বিষম সময়।” (২ তীমথিয় ৩:১-৫) যীশু খ্রীষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে শেষকালে, “জাতিগণের ক্লেশ হইবে” এবং “ভয়ে, এবং ভূমণ্ডলে যাহা যাহা ঘটিবে তাহার আশঙ্কায়, মানুষের প্রাণ উড়িয়া যাইবে।”—লূক ২১:৭-১১, ২৫-২৭; মথি ২৪:৩-১৪.
যখন লোকেরা ক্রমাগত উদ্বেগ, ভয়, দুঃখ, অথবা ওই ধরনের অন্যান্য নেতিবাচক মানসিক অবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করে, তারা প্রায়ই বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। প্রিয়জনের মৃত্যু, বিবাহবিচ্ছেদ, কর্মচ্যুতি, অথবা কঠিন অসুস্থতা চরম দুঃখের অথবা বিষণ্ণতার কারণ হতে পারে। লোকেরা যখন ব্যর্থ বোধ করে এবং মনে করে সকলকে নিরাশ করেছে, তখন তাদের মধ্যে এক মূল্যহীনতার মনোভাবের সৃষ্টি হয় যা তাদের বিষণ্ণ করে দেয়। কঠিন পরিস্থিতিতে যে কেউ বিধ্বস্ত হতে পারে, কিন্তু যখন একজন ব্যক্তি নিরাশ মনোভাব পোষণ করে এবং মন্দ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার কোন পথ খুঁজে পায় না, তখন তীব্র বিষণ্ণতা আসতে পারে।
প্রাচীনকালের লোকেরা একই ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। ইয়োব শারীরিক অসুস্থতা ও ব্যক্তিগত দুর্দশা ভোগ করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন যে ঈশ্বর তাকে পরিত্যাগ করেছেন, সুতরাং তিনি জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছিলেন। (ইয়োব ১০:১; ২৯:২, ৪, ৫) যাকোব তার পুত্রের আপাত মৃত্যুতে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন, তিনি সান্ত্বনা দান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং মৃত্যু চেয়েছিলেন। (আদিপুস্তক ৩৭:৩৩-৩৫) সাংঘাতিক ভুলের জন্য নিজেকে দোষী মনে করে, রাজা দায়ূদ অনুশোচনা করেন: “আমি সমস্ত দিন বিষণ্ণ হইয়া বেড়াইতেছি। আমি অবসন্ন হইয়াছি।”—গীতসংহিতা ৩৮:৬, ৮; ২ করিন্থীয় ৭:৫, ৬.
বর্তমানে, অনেকে একটি দৈনন্দিন তালিকা যা তাদের মানসিক এবং দৈহিক ক্ষমতার বাইরে, তা অনুসরণ করতে গিয়ে নিজেদের উপর অত্যধিক চাপ দেয়, ফলে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। স্পষ্টত যদি চাপ, নেতিবাচক চিন্তাধারা ও আবেগের সঙ্গে জড়িত হয়, তাহলে শরীরে প্রতিক্রিয়া ও মস্তিষ্কে রাসায়নিক পদার্থে অসমতা দেখা দিতে পারে, ফলে বিষণ্ণতা আসতে পারে।—তুলনা করুন হিতোপদেশ ১৪:৩০.
সাহায্য যা তাদের প্রয়োজন
ইপাফ্রদীত, প্রথম শতাব্দীর ফিলিপীয়ের একজন খ্রীষ্টান, “ব্যাকুল হয়েছিলেন কারণ [তার বন্ধুরা] শুনিয়াছিল তিনি পীড়িত।” ইপাফ্রদীতকে, তার বন্ধুরা পৌলের জন্য কিছু জিনিসপত্র দিয়ে রোমে পাঠালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় মনে করেন, হয়ত তিনি তার বন্ধুদের নিরাশ করেছেন এবং তারা তাকে অপদার্থ বলে মনে করেছে। (ফিলিপীয় ২:২৫-২৭; ৪:১৮) প্রেরিত পৌল কিভাবে সাহায্য করেছিলেন?
তিনি ফিলিপীয় বন্ধুদের একটি চিঠি দিয়ে ইপাফ্রদীতকে বাড়ি পাঠান যা বলে: “তোমরা [ইপাফ্রদীতকে] প্রভুতে সম্পূর্ণ আনন্দ সহকারে গ্রহন করিও, এবং এই প্রকার লোকদিগকে সমাদর করিও।” (ফিলিপীয় ২:২৮-৩০) আসলে তার সম্বন্ধে পৌলের প্রশংসা এবং ফিলিপীয়দের প্রীতি ও উষ্ণ অভ্যর্থনা, নিশ্চিতভাবে ইপাফ্রদীতকে সান্ত্বনা দেয় এবং সাহায্য করে তার বিষণ্ণতা দূর করতে।
নিঃসন্দেহে, বাইবেলের উপদেশ “ক্ষীণদিগকে সান্ত্বনা কর” সবচেয়ে উপযুক্ত। “আপনার জানা প্রয়োজন যে অন্যরা আপনার বিষয়ে চিন্তা করে,” একজন মহিলা যিনি বিষণ্ণতায় ভুগতেন তিনি বলেছিলেন। “আপনার শোনা প্রয়োজন কেউ যেন আপনাকে বলুক, ‘আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি; সব ঠিক হয়ে যাবে।’”
বিষণ্ণ ব্যক্তিকে প্রায়ই নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে এমন এক সহানুভূতি সম্পন্ন ব্যক্তিকে খুঁজে বার করতে হয় যার কাছে সে তার মনের কথা বলতে পারে। এই ব্যক্তিকে একজন উত্তম শ্রোতা ও খুব ধৈর্যশীল হতে হবে। সে বিষণ্ণচিত্ত ব্যক্তির প্রতি এই ধরনের উপদেশমূলক অথবা নিষ্পত্তিমূলক মন্তব্য এড়িয়ে যাবে, যেমন,
‘আপনার ঐরকম ভাবা উচিৎ হয়নি,’ অথবা ‘ওটি ভুল মনোভাব।’ এতে বিষণ্ণ ব্যক্তির মন সহজেই ভেঙে পড়ে এবং এই ধরনের সমালোচনামূলক মন্তব্যে সেই ব্যক্তি নিজেকে আরও খারাপ ভাবতে থাকে।বিষণ্ণ ব্যক্তি নিজেকে ব্যর্থ মনে করতে পারে। (যোনা ৪:৩) তবুও, একজন ব্যক্তির মনে রাখা উচিৎ যে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর তাকে কতটা মূল্য দেন সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ যীশু খ্রীষ্টকে “মান্য করেনি” কিন্তু তাতে ঈশ্বরের নিকট তাঁর প্রকৃত মূল্য কমেনি। (যিশাইয় ৫৩:৩) নিশ্চিত থাকুন, ঈশ্বর যেমন তাঁর প্রিয় পুত্রকে প্রেম করেন, তেমনি তিনি আপনাকেও করেন।—যোহন ৩:১৬.
যীশু সেই সকল বিষণ্ণ ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি দেখান এবং ব্যক্তিগতভাবে তারা কত মূল্যবান তা দেখতে সাহায্য করেন। (মথি ৯:৩৬; ১১:২৮-৩০; ১৪:১৪) তিনি ব্যাখ্যা করেন এমনকি ক্ষুদ্র, তুচ্ছ চড়াই পাখিও ঈশ্বরের কাছে মূল্যবান। তিনি বলেন “তাহাদের মধ্যে একটিও ঈশ্বরের দৃষ্টিগোচরে গুপ্ত নয়।” মানুষেরা যারা তাঁর ইচ্ছানুসারে চলার চেষ্টা করে তারা তাঁর কাছে আরও কতই না বেশী মূল্যবান! এদের সম্বন্ধে যীশু বলেন: “এমন কি, তোমাদের মস্তকের কেশগুলিও সমস্ত গণিত আছে।”—লূক ১২:৬, ৭.
সত্য, একজন ব্যক্তি যে নিদারুণ বিষণ্ণতা, দুর্বলতা ও ভুলভ্রান্তিতে ভুগছে, তার পক্ষে এটি বিশ্বাস করা কঠিন হতে পারে যে ঈশ্বর তাকে এত মূল্য দেন। সে হয়ত নিশ্চিত হতে পারে যে ঈশ্বরের প্রেম ও অনুগ্রহ লাভের সে অযোগ্য। ঈশ্বরের বাক্য স্বীকার করে, “আমাদের হৃদয় আমাদিগকে দোষী করে।” কিন্তু সেটিই কি আসল বিষয়? না তা নয়। ঈশ্বর উপলব্ধি করেন যে পাপী মানুষ নেতিবাচক চিন্তা করতে ও এমনকি নিজেকে অপরাধী মনে করতে পারে। সেইজন্য তাঁর বাক্য আশ্বাস দেয়: “ঈশ্বর আমাদের হৃদয় অপেক্ষা মহান্ এবং সকলই জানেন।”—১ যোহন ৩:১৯, ২০.
হ্যাঁ, আমাদের প্রেমময় স্বর্গীয় পিতা আমাদের পাপ ও ভুলভ্রান্তির চেয়ে আরও অধিক কিছু দেখেন। অপরাধের পরিস্থিতি, আমাদের সম্পূর্ণ জীবনধারা, মানসিকতা এবং আমাদের উদ্দেব্য তিনি জানেন। তিনি জানেন যে আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পাপ, অসুস্থতা, ও মৃত্যু পেয়েছি এবং সেইজন্য আমাদের ক্ষমতা অতি সীমিত। আসলে যখন আমরা দুঃখিত ও নিজেদের উপর বিরক্ত হই তখনই তা প্রমাণ করে যে আমরা পাপ করতে চাই না এবং অতটা পতিত হইনি। বাইবেল বলে যে আমরা আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে “অসারতার বশীকৃত” হয়েছি। সুতরাং ঈশ্বর রোমীয় ৫:১২; ৮:২০.
আমাদের দুঃখজনক অবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তিনি আমাদের দুর্বলতাগুলিকে করুণার সাথে বিবেচনা করেন।—আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়, “যিহোবা স্নেহশীল ও কৃপাময়।” “পশ্চিমদিক্ হইতে পূর্ব্বদিক্ যেমন দূরবর্ত্তী, তিনি আমাদের হইতে আমাদের অপরাধ সকল তেমনি দূরবর্ত্তী করিয়াছেন। কারণ তিনি আমাদের গঠন জানেন; আমরা যে ধূলিমাত্র, ইহা তাঁহার স্মরণে আছে।” (গীতসংহিতা ১০৩:৮, ১২, ১৪) সত্যই, যিহোবা হলেন “সমস্ত সান্ত্বনার ঈশ্বর; তিনি আমাদের সমস্ত ক্লেশের মধ্যে আমাদিগকে সান্ত্বনা করেন।”—২ করিন্থীয় ১:৩, ৪.
বিষণ্ণ ব্যক্তিদের যে সাহায্যের প্রয়োজন তার বেশীর ভাগ আসে তাদের স্নেহশীল ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়া থেকে এবং তাঁর আমন্ত্রণ ‘তাঁহাতে তাহাদের ভার অর্পণ কর’ এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে। তিনি বাস্তবিকই “চূর্ণ লোকদের হৃদয়কে সঞ্জীবিত করতে” পারেন। (গীতসংহিতা ৫৫:২২; যিশাইয় ৫৭:১৫) তাই ঈশ্বরের বাক্য প্রার্থনা করতে উৎসাহ দেয়, এই বলে: “তোমাদের সমস্ত ভাবনার ভার [যিহোবার] উপরে ফেলিয়া দেও; কেননা তিনি তোমাদের জন্য চিন্তা করেন।” (১ পিতর ৫:৭) হ্যাঁ, প্রার্থনা এবং বিনতি দ্বারা লোকেরা ঈশ্বরের নিকটবর্তী হতে ও “সমস্ত চিন্তার অতীত যে ঈশ্বরের শান্তি” তা উপভোগ করতে পারে।—ফিলিপীয় ৪:৬, ৭; গীতসংহিতা ১৬:৮, ৯.
জীবনধারাকে ব্যবহারিকরূপে মানিয়ে নিলে একজনকে বিষণ্ণ মনোভাব কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। শরীরচর্চা, পুষ্টিকর খাদ্য, মুক্ত বাতাস ও প্রয়োজনীয় বিশ্রাম গ্রহণ এবং অত্যধিক টেলিভিশন দেখা এড়িয়ে চলা অত্যন্ত প্রয়োজন। একজন মহিলা, উদ্যমের সাথে হাঁটাচলা করিয়ে বিষণ্ণ ব্যক্তিদের সাহায্য করেছিলেন। যখন একজন বিষণ্ণ মহিলা বলেছিলেন: “আমি হাঁটতে চাই না,” মহিলাটি শান্তভাবে কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন: “হ্যাঁ, তোমাকে হাঁটতেই হবে।” মহিলাটি বলেছিলেন: ‘আমরা ছয় কিলোমিটার হেঁটেছিলাম। যখন আমরা ফিরে এসেছিলাম, তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু তিনি সুস্থ বোধ করেছিলেন। চেষ্টা না করা পর্যন্ত আপনি বিশ্বাসই করতে পারবেন না যে উদ্যমের সাথে শরীরচর্চা কত সাহায্যকারী।’
কিন্তু, কোন কোন সময় সমস্ত কিছু এমনকি চিকিৎসা পর্যন্ত চেষ্টা করেও বিষণ্ণতাকে সর্ম্পূণভাবে জয় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক মধ্যবয়স্কা মহিলা বলেন, “আমি সব রকমের চেষ্টা করেছি, কিন্তু বিষণ্ণতা থেকেই গেছে।” ঠিক যেমন, রোমীয় ১২:১২; ১৫:৪.
এখন প্রায়ই কোন অন্ধ, বধির, অথবা খঞ্জ ব্যক্তিকে সারিয়ে তোলা অসম্ভব হয়। তবুও, বিষণ্ণ ব্যক্তিরা ঈশ্বরের বাক্য যা মানুষের সকল প্রকার অসুস্থতা থেকে চিরস্থায়ী মুক্তির নিশ্চিত আশা যোগায়, তা নিয়মিত অধ্যয়ন করার দ্বারা সান্ত্বনা ও আশা খুঁজে পেতে পারে।—যখন আর কেউ পুনরায় বিষণ্ণ হবে না
যখন যীশু পৃথিবীর উপর শেষকালে ভয়াবহ ঘটনাগুলি ঘটবে বলে বর্ণনা করেন, তিনি আরও বলেন: “এ সকল ঘটনা আরম্ভ হইলে তোমরা ঊর্দ্ধদৃষ্টি করিও, মাথা তুলিও, কেননা তোমাদের মুক্তি সন্নিকট।” (লূক ২১:২৮) যীশু ঈশ্বরের ধার্মিক নতুন জগতে মুক্তির কথা বলছিলেন, যেখানে “সৃষ্টি নিজেও ক্ষয়ের দাসত্ব হইতে মুক্ত হইয়া ঈশ্বরের সন্তানগণের প্রতাপের স্বাধীনতা পাইবে।”—রোমীয় ৮:২১.
অতীতের বোঝাগুলি থেকে মুক্ত হওয়া এবং পরিশুদ্ধ মন নিয়ে প্রতিদিন জেগে ওঠা, আকুল আগ্রহে দৈনন্দিন কাজে অবতীর্ণ হওয়া মানবজাতির জন্য কতই না আনন্দের হবে! বিষণ্ণতার ছায়ায় আর কেউ আচ্ছন্ন হবে না। মানবজাতির প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এই যে ঈশ্বর “তাহাদের সমস্ত নেত্রজল মুছাইয়া দিবেন; এবং মৃত্যু আর হইবে না; শোক বা আর্ত্তনাদ বা ব্যথাও আর হইবে না; কারণ প্রথম বিষয় সকল লুপ্ত হইল।”—প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪.
উল্লেখ না করা থাকলে ব্যবহৃত বাইবেল অনুবাদ বাইবেল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার পবিত্র বাইবেল থেকে গৃহীত।