শৈশবাবস্থা থেকে সন্তানদের শিক্ষা দেওয়া
অধ্যায় ৯
শৈশবাবস্থা থেকে সন্তানদের শিক্ষা দেওয়া
শিশুর মনকে তুলনা করা হয় কোন কিছু না লেখা এক সাদা পৃষ্ঠার সাথে। আসলে, শিশু মাতৃজঠরে থাকার সময়েও তার মনে বহু ছাপ ফেলা হয়ে থাকে। আর প্রজননের উত্তরাধিকার অনুসারে বিশেষ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লেখা হয় যা মুছে ফেলা যায় না। কিন্তু জন্মাবার পরক্ষণ থেকেই শেখার এক অস্বাভাবিক ক্ষমতা থাকে। এক পৃষ্ঠার পরিবর্তে যেন সম্পূর্ণ এক লাইব্রেরী তার পৃষ্ঠাগুলিতে তথ্যাদি ছাপাবার জন্য অপেক্ষা করে।
২ শিশুর মস্তিষ্কের ওজন তার পরিণত বয়সে মস্তিষ্কের ওজনের শুধুমাত্র এক চতুর্থাংশ। কিন্তু মস্তিষ্ক এত দ্রুত বৃদ্ধি পায় যে দুই বছর বয়সেই তার মস্তিষ্কের ওজন পরিণত বয়সের মস্তিষ্কের ওজনের তিন চতুর্থাংশ হয়! বুদ্ধির বিকাশ পাল্লা দিয়ে বাড়ে। গবেষকগণ বলেন, শিশুর জীবনের প্রথম চার বছরে যতখানি বুদ্ধির বিকাশ ঘটে ততখানিই পরবর্তী তেরো বছরে ঘটে থাকে। এমন কি, অনেকে বলেন যে “পঞ্চম জন্মদিন হওয়ার আগে শিশু যা শেখে তা হল পরবর্তীকালে যা কিছুর সে সম্মুখীন হয় তার মধ্যে সবচেয়ে কষ্টকর বিষয়।”
৩ সাধারণ ধারণাগুলি যেমন ডান ও বাঁ, উপর ও নীচ, ভর্তি ও খালি, তার সাথে পরিমাপ ও ওজনের তুলনামূলক মাত্রাগুলি, এই সবই আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু শিশুকে অন্যান্য ধারণাগুলি এবং এই সকলই শিখতে হয়। কথা বলার জ্ঞানটিও শিশুর মনে গেঁথে গিয়ে দৃঢ় হওয়া দরকার।
৪ কিছু ব্যক্তি ভাষাকে এইভাবে মূল্যায়ন করেন, “মানুষকে সাধন করতে দেওয়া সমস্ত কাজের মধ্যে মনে হয় এটি সবচেয়ে কঠিন বুদ্ধিপ্রযুক্ত কর্ম সম্পাদন।” আপনি যদি কখনও কোন নতুন ভাষা শেখার জন্য প্রচেষ্টা করে থাকেন তাহলে আপনি হয়ত এই বক্তব্যের সাথে একমত হবেন। কিন্তু আপনার অন্তত সুবিধা আছে যে আপনি জানেন যে ভাষা কিভাবে কাজ করে। শিশু কিন্তু জানে না, তবুও তার মন ভাষার জ্ঞানকে গ্রহণ করতে ও তা কাজে লাগাতে সক্ষম। শুধুমাত্র তাই নয়, যে ঘরে অথবা এলাকায় দুটি ভাষা ব্যবহার হয় সেখানকার ছোট ছেলেমেয়েরা খুব সহজেই হয়ত দুটি ভাষা বলতে পারে—এমন কি তারা স্কুলে যাওয়ার আগেই বলতে শুরু করে দেয়! সুতরাং, বুদ্ধি আছে, শুধুমাত্র বিকাশের অপেক্ষা।
সঙ্গে সঙ্গে শুরু করার সময়!
৫ প্রেরিত পৌল তার সাথী তীমথিয়কে লেখার সময় স্মরণ করিয়ে দেন যে তিনি “শিশুকাল” থেকেই পবিত্র লেখাগুলির সাথে পরিচিত আছেন। (২ তীমথিয় ৩:১৫) শিশুর শিক্ষা গ্রহণ করার স্বাভাবিক ক্ষুধাকে শুধুমাত্র বিজ্ঞ পিতামাতারাই উপলব্ধি করতে পারেন। শিশুরা খুবই লক্ষ্য করে, তাও আবার সমস্ত চোখ কান দিয়ে। পিতামাতারা এ সম্বন্ধে সজাগ থাকুন বা নাই থাকুন ছোট্ট বাচ্চাটি তথ্যাদি গ্রহণ করতে, জড়ো করতে, যোগ করতে, পরিসমাপ্তিতে আসতে ব্যস্ত থাকে। আসলে, পিতামাতারা যদি সতর্ক না হন তাহলে শিশু পিতামাতাকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী স্বকার্যে লাগাতে খুব চমকপ্রদভাবে অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে শিখে যাবে। সুতরাং ঈশ্বরের বাক্যে যে পরামর্শটি দেওয়া হয় সেটি জন্মের পর থেকেই প্রযোজ্য: “বালককে তাহার গন্তব্য পথানুরূপ শিক্ষা দেও, সে প্রাচীন হইলেও তাহা ছাড়িবে না।” (হিতোপদেশ ২২:৬) প্রথম শিক্ষাটি হল নিশ্চয়ই অত্যন্ত স্নেহ যত্ন দিয়ে ভালবাসার। কিন্তু তার সাথে কোমল কিন্তু দৃঢ়ভাবে প্রয়োজনীয় শাসনও করা দরকার।
৬ শিশুর সাথে “শিশু-ভাষা”য় কথা বলবেন না কিন্তু বড়রা যেমন সাধারণভাবে কথা বলে সেইভাবে বলুন, যেটি আপনি চান যে সে শিখুক। যখন ছোট্ট বাচ্চাটি কথা বলতে শেখে তখন সে আপনাকে প্রশ্ন করে নাজেহাল করে তোলে: ‘কেন বৃষ্টি পড়ে? আমি কোথা থেকে এসেছি? দিনের বেলা তারাগুলো কোথায় যায়? তুমি কী করছ? কেন এইরকম? কেন ওই রকম?’ আসতেই থাকে এই অফুরন্ত প্রশ্নগুলি! সেগুলি শুনুন, কারণ শিশুর শেখার সবচেয়ে বড় উপায় হল এই প্রশ্ন। প্রশ্ন করাকে বন্ধ করে দিলে মানসিক বিকাশও রোধ হয়ে যেতে পারে।
৭ কিন্তু স্মরণে রাখুন, প্রেরিত যেমন করেছিলেন, “আমি যখন শিশু ছিলাম, তখন শিশুর ন্যায় কথা কহিতাম, শিশুর ন্যায় চিন্তা করিতাম, শিশুর ন্যায় বিচার করিতাম।” (১ করিন্থীয় ১৩:১১) প্রশ্নগুলির সরলভাবে ও ছোট করে যতদূর সম্ভব আপনি ভাল উত্তর দিন। যখন কোন শিশু জিজ্ঞাসা করে যে ‘কেন বৃষ্টি পড়ে?’ তখন সে এক জটিল বিশদ উত্তর চায় না। এরূপ কিছু উত্তর যেমন, ‘মেঘগুলো জলের জন্য ভারী হয়ে যায় তাই জল নিচে পড়ে যায়,’ হয়ত তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে। শিশুরা খুব কম সময়ের জন্য মনোযোগ দিতে পারে; খুব তাড়াতাড়ি অন্য কোন বিষয়ের প্রতি তাদের মনোযোগ চলে যায়। আপনি যেমন, সন্তান যতদিন না কঠিন খাদ্য খেতে পারছে ততদিন দুধ খাওয়ান, ঠিক তেমনই কোন কিছু সম্পর্কে সে বিশদ বিবরণ না বোঝা অবধি তাকে সরল তথ্যাদি দিতে পারেন।—তুলনা করুন ইব্রীয় ৫:১৩, ১৪.
৮ শেখা উন্নতিমূলক হওয়া দরকার। যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, তীমথিয় শিশুকাল থেকে শাস্ত্রের সাথে পরিচিত ছিলেন। খুব ছোটবেলা সম্পর্কে স্মরণ করলে তার মনে পড়বে বাইবেল থেকে তার শিক্ষাও। নিশ্চয় এটি ছিল প্রগতিমূলক, যেমন আজকাল বাবামায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে শেখায়। আপনার সন্তানকে পড়ে শোনান। যদি সে
শিশু হয়, তাহলে তাকে কোলে বসিয়ে, জড়িয়ে ধরে, মিষ্টি স্বরে তার কাছে পডুন। সে এক আন্তরিক সুরক্ষা ও আনন্দ উপলব্ধি করবে এবং সেই সম্বন্ধে খুব কম বুঝলেও পড়া হবে এক সুন্দর অভিজ্ঞতা। পরে, আপনি হয়ত তাকে খেলার ছলে বর্ণ পরিচয় করাতে পারেন। তারপর অক্ষর থেকে শব্দ তৈরি ও শব্দ থেকে অবশেষে বাক্য তৈরি করতে পারেন। যতদূর সম্ভব, শেখার এই উপায়কে আনন্দদায়ক করে তুলুন।৯ উদাহরণস্বরূপ, এক দম্পতি তাদের তিন বছরের বাচ্চাকে জোরে জোরে পড়ে শোনাবার সময় প্রত্যেকটি শব্দকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে পড়তেন যাতে শিশুটি অনুসরণ করতে পারে। কোন কোন শব্দের ক্ষেত্রে তারা একটু থামতেন, আর বাচ্চাটি শব্দটি বলত, যেমন “ঈশ্বর,” “যীশু,” “মানুষ,” “গাছ।” ধীরে ধীরে সে অনেকগুলি শব্দ পড়তে আরম্ভ করল এবং চার বছর বয়সে সে বেশির ভাগ শব্দ পড়তে পারত। পড়ার সাথে সাথে আসে লেখা, প্রথমে এক একটি অক্ষর, তারপর সম্পূর্ণ শব্দ। নিজের নামটিকে লেখা সন্তানকে রোমাঞ্চিত করে!
১০ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বসহ প্রত্যেক সন্তান হল পৃথক এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও গুণগুলি অনুসারে তাকে উন্নতি করতে সাহায্য করা উচিৎ। প্রত্যেকটি সন্তানকে তার প্রাপ্ত শক্তি ও ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে আপনি যদি শিক্ষা দেন তাহলে সে অন্য ছেলেমেয়েদের গুণাবলিতে হিংসা বোধ করবে না। প্রত্যেক শিশু, সে যেরূপ তাকে সেইভাবেই ভালবাসা এবং প্রশংসা করা উচিৎ। মন্দ ইচ্ছাগুলিকে বর্জন ও নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করার সময়, একটি পূর্বনির্ধারিত ছাঁচে শিশুকে ফেলার চেষ্টা করা উচিৎ নয়। পরিবর্তে, তার নিজস্ব উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে ভালভাবে ব্যবহার করার প্রতি পরিচালনা করুন।
১১ পিতামাতারা একটি সন্তানের সাথে অপর সন্তানের শ্রেষ্ঠত্ব বা হীনতার তুলনা করে, স্বার্থপর প্রতিযোগিতার আত্মা গড়ে তুলতে পারেন। মথি ১৮:১-৪) তাই, একটি সন্তানের প্রতিকূলে অপর সন্তানের সাথে তার তুলনা করাটি এড়িয়ে চলুন। শিশু সেটিকে ব্যর্থতা হিসাবে নিতে পারে। প্রথমদিকে সে দুঃখিত বোধ করবে, কিন্তু যদি তার প্রতি এরূপ ব্যবহার করেই যাওয়া হয় তাহলে সে সম্ভবত বিরোধী হয়ে উঠবে। অপরপক্ষে, যে শিশুকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হচ্ছে, সে হয়ত অহঙ্কারীতে পরিণত হতে এবং অপরের অপছন্দের কারণ হতে পারে। পিতামাতারূপে, আপনার ভালবাসা ও সমর্থন যেন কখনই একটি সন্তানের সাথে অপর সন্তানের তুলনার উপর নির্ভর না করে। বৈচিত্র্য আনন্দদায়ক। বৈচিত্র্য ও উৎকর্ষতার জন্য অর্কেস্ট্রায় বহু বাদ্যযন্ত্র থাকে কিন্তু প্রত্যেকটি সঙ্গতি রাখে। পারিবারিক বৃত্তে বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব মাধুর্য ও আগ্রহ আনে, আর সেই সঙ্গতি কখনই ভেঙ্গে পড়ে না যখন পরিবারের সকল সদস্য স্রষ্টার সঠিক নীতি অনুসারে নিজেদের গঠন করে।
শিশুরা শিশুকালেই জন্মগত স্বার্থপরতার ইঙ্গিত দিয়ে থাকে, কিন্তু তাদের প্রথম থেকেই পদ, শ্রেষ্ঠত্ব এবং আত্মাভিমানের মত কোন ধারণা থাকে না। সেই কারণেই, যীশুর শিষ্যেরা যখন কোন এক উপলক্ষে উচ্চাকাঙ্ক্ষার আত্মা ও আত্মাভিমানের চিন্তা প্রদর্শন করেন তখন সেটি সংশোধন করতে তিনি এক ছোট্ট শিশুর উদাহরণ দেখাতে পেরেছিলেন। (আপনার সন্তানকে বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করুন
১২ ঈশ্বরের বাক্য বলে, যে মানুষ হাঁটে, সেই ‘মনুষ্যের পথ তাহার বশে নয়।’ (যিরমিয় ১০:২৩) কিন্তু মানুষেরা বলে সেটি তাদের বশে আছে। তাই তারা ঐশিক পরিচালনা প্রত্যাখ্যান করে, মানুষের পরিচালনা গ্রহণ করে, একটির পর একটি সমস্যায় পড়ে এবং অবশেষে ঈশ্বরই যে সত্য তা প্রমাণ করে। যিহোবা ঈশ্বর বলেন যে এমন পথ আছে যা লোকের চোখে সঠিক দেখায় কিন্তু তার শেষ মৃত্যুতে হয়। (হিতোপদেশ ১৪:১২) বহুদিনব্যাপী লোকেরা, তাদের নিজেদের কাছে যে পথটি সঠিক মনে করে সেই পথ গ্রহণ করেছে এবং তা যুদ্ধ, খাদ্যাভাব, রোগব্যাধি ও মৃত্যুতে পরিচালিত করেছে। পরিণত বয়স্ক, অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে যে পথটি সঠিক মনে হয় তা যদি মৃত্যুতে শেষ হয়, তাহলে যে পথ শিশুর কাছে সঠিক বলে মনে হয় তা কিভাবে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে? যে মানুষ হাঁটে, সে যদি তার পদক্ষেপ নির্দেশ করতে না পারে তাহলে যে শিশু টলমল করে সে কিরূপে তার জীবনকে পরিচালিত করতে পারবে? স্রষ্টা তাঁর বাক্যের মাধ্যমে পিতামাতা ও শিশু উভয়ের জন্যই নির্দেশ প্রদান করেছেন।
১৩ পিতামাতাদের ঈশ্বর বলেন: “এই যে সকল কথা আমি অদ্য তোমাকে আজ্ঞা করি, তাহা তোমার হৃদয়ে থাকুক। আর তোমরা প্রত্যেকে আপন আপন সন্তানগণকে এ সকল যত্নপূর্ব্বক শিক্ষা দিবে, এবং গৃহে বসিবার কিম্বা পথে চলিবার সময়ে এবং শয়ন কিম্বা গাত্রোত্থান কালে ঐ সমস্তের কথোপকথন করিবে।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৬, ৭) যে কোন সময় ও সবসময়েই, উপযুক্ত সুযোগ পেলেই নির্দেশ দেওয়া দরকার। যদি পরিবার সকালে একসঙ্গে চা-জলখাবার খায়, যদিও সেই সময় অনেকের ক্ষেত্রে স্কুলে বা কাজে যাওয়ার প্রস্তুতির ব্যস্ততা থাকে, তবুও খাদ্যের জন্য ধন্যবাদ দিলে এবং পরিবারের আত্মিক দিক দিয়ে উপকার সম্পর্কে কিছু বিষয় বললে মনকে স্রষ্টার প্রতি নিয়ে যায়। তার মধ্যে দিনের আগত কাজগুলি ও স্কুলের কাজগুলি সম্বন্ধে এবং সমস্যা এলে তার মোকাবিলা করতে বিচক্ষণ পরামর্শ সম্বন্ধে দুই এক কথা বলা যেতে পারে। যদি পিতামাতারা ছোট্ট ছেলেমেয়েদের প্রতি একটু বেশি মনোযোগ দেন তাহলে রাত্রে “শয়ন,” করার সময় তাদের জন্য খুবই আনন্দের হয়ে ওঠে। শোয়ার সময় গল্পগুলি ছোট্টদের কাছে অনেক মূল্য রাখে আর তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য উত্তম মাধ্যম হতে পারে। বাইবেলে প্রচুর বিষয় আছে বাচ্চার জন্য উপভোগ্য করে তুলতে যার জন্য প্রয়োজন শুধুমাত্র বাবামায়ের বলার কৌশল ও আন্তরিকতা। আপনার জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শিশুর হৃদয় বিশেষভাবে স্পর্শ করতে পারে যা তার জন্য এক উত্তম শিক্ষা হতে পারে। নতুন নতুন গল্প বলা কষ্টকর বোধ হলেও, কিন্তু বেশির ভাগ সময় আপনি দেখবেন যে শিশুরা সেই একই গল্প বার বার শুনতে ভালবাসে। এই অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে, আপনি দেখবেন যে আপনার সন্তানের সাথে ভাব-বিনিময়ের সংযোগ আরও বেড়ে গেছে। শোয়ার সময় ছোট্টদের সাথে প্রার্থনা করলে, যিনি তাদের সবচেয়ে বেশি নির্দেশ দেন ও সুরক্ষিত রাখেন, তাঁর সাথে খুব শীঘ্রই সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে।—ইফিষীয় ৩:২০; ফিলিপীয় ৪:৬, ৭.
১৪ আপনি যেখানেই থাকুন, ‘ঘরে বসে থাকার সময়’ বা ‘পথে যাত্রার সময়’ আপনার সবসময় সুযোগ আছে সন্তানকে কার্যকারী ও আগ্রহজনকরূপে শিক্ষা দেওয়ার। ছেলেমেয়েদের জন্য এর মধ্যে কিছু খেলার ছলে করা যেতে পারে। একটি দম্পতি এই বিবরণটি দেন যে বাইবেল অধ্যয়ন সভা থেকে বিষয়গুলি মনে করতে কিভাবে তার ছেলেমেয়েদের সেটি সাহায্য করেছে:
‘একদিন সন্ধ্যাবেলা আমরা ছয় বছরের ছোট্ট ছেলেটিকে আমাদের সাথে নিয়ে যাই, যে সাধারণত সভাতে খুব বেশি মনোযোগ দিত না। হলে যাওয়ার সময়, আমি বলি: “চল আমরা একটা খেলা খেলব। ঘরে ফিরে আসার সময় দেখা যাক যে সভাতে গাওয়া গান ও কিছু মূল বিষয়গুলি, কে কতটা মনে রাখতে পারে।” ঘরে আসার পথে আমরা অবাক হয়ে যাই। সবচেয়ে ছোট ছেলেটি, যে সাধারণত অমনোযোগী, তাকে প্রথমে বলতে সুযোগ দেওয়া হয় এবং সে বেশ অনেকগুলি বিষয় মনে করে বলতে পারে। আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের মন্তব্যগুলিও বলে ও তারপর আমরা বাবামা দুজনেই মন্তব্য করি। কাজের পরিবর্তে তা ছিল তাদের কাছে এক খেলা।’
১৫ সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে সে তার মনোভাব প্রকাশ করতে, ছবি আঁকতে, কোন কাজ করতে এবং কোন যন্ত্রের সাহায্যে সঙ্গীত বাজাতে শিখবে। কার্য সম্পাদনের এক মনোভাব সে বোধ করে। এক অর্থে, তার কাজ হল তার নিজের প্রসার। এটি হল তার খুবই ব্যক্তিগত বিষয়। আপনি যদি দেখে বলেন ‘চমৎকার,’ তাহলে সন্তান খুব খুশি হয়। তার কাজেতে কিছু দেখে প্রকৃতই প্রশংসা করুন, সে উৎসাহ পাবে। গালাতীয় ৬:৪ পদের নীতি ছেলেমেয়েদের প্রতিও প্রযোজ্য হতে পারে: “প্রত্যেক জন নিজ নিজ কর্ম্মের পরীক্ষা করুক, তাহা হইলে সে কেবল আপনার কাছে শ্লাঘা করিবার হেতু পাইবে, অপরের কাছে নয়।” বিশেষভাবে প্রথম প্রচেষ্টার জন্য সন্তানের উৎসাহের প্রয়োজন। যদি তার বয়সের তুলনায় বিষয়টি ভাল হয় তাহলে তাকে প্রশংসা করুন! যদি তা ভাল না হয়ে থাকে তাহলে তার প্রচেষ্টাকে প্রশংসা করুন, আর একবার চেষ্টা করতে উৎসাহ দিন। যাইহোক, প্রথম চেষ্টায় তো সে চলতে শেখেনি।
সরাসরি সমালোচনা করলে সে হয়ত দুঃখ পাবে ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। যদি প্রয়োজন হয় সেই সম্পর্কে কোন একটি বিষয়ের উপর প্রশ্ন তুলুন, কিন্তু সেটি তার এক ব্যর্থতা হিসাবে যেন না করা হয়। যেমন, তার আঁকা ছবিটি নিয়ে তার উপরেই আবার আঁকার চাইতে আপনি সেটিকে কী করে আর একটু ভাল করা যায় তা অন্য একটি কাগজে এঁকে দেখাতে পারেন। তাতে সে যদি চায় তাহলে সে তার আঁকাকে আরও ভাল করতে পারবে। তার প্রচেষ্টাকে উৎসাহ দিয়ে আপনি তার বৃদ্ধিকেও উৎসাহ দিয়ে থাকেন; কর্কশভাবে সমালোচনা করে আপনি তাকে দুঃখিত করতে পারেন বা তার চেষ্টা করার ইচ্ছাকেও দমন করিয়ে দিতে পারেন। হ্যাঁ,যৌন বিষয় সম্পর্কে আমি কিভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি?
১৬ আপনি সন্তানের প্রশ্নের উত্তর দেন এবং তাকে কথাবার্তা বলতে উৎসাহ দেন। কিন্তু হঠাৎ আপনাকে যৌন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। আপনি কি খোলাখুলিভাবে উত্তর দেন, না উল্টোপাল্টা উত্তর দেন, যেমন এই ছোট্ট ভাই বা বোনকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে? আপনি কি সঠিক বিষয় বলবেন অথবা চাইবেন যে ছেলেমেয়েরা ঠিক নয় এমন, এমন কি ভুল, হয়ত নোংরাভাবে বড় বড় ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে উত্তরগুলি পায়? যৌন বিষয় ও জননেন্দ্রিয় সম্পর্কে বাইবেলে বেশ কয়েকবার খোলাখুলিভাবে উদ্ধৃত করা আছে। (আদিপুস্তক ১৭:১১; ১৮:১১; ৩০:১৬, ১৭; লেবীয় পুস্তক ১৫:২) যেখানে ঈশ্বরের বাক্য পড়া হবে সেখানে একত্র হওয়া সম্পর্কে তাঁর লোকেদের নির্দেশ দেওয়ার সময়, ঈশ্বর বলেন: “তুমি লোকদিগকে, পুরুষ, স্ত্রী, বালক-বালিকা . . . সকলকে একত্র করিবে, যেন তাহারা শুনিয়া শিক্ষা পায়।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩১:১২) সুতরাং, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেই সব উদ্ধৃতিগুলি এক গম্ভীর, সম্মানজনক পরিস্থিতিতে শুনত, “নোংরা কথা” হিসাবে নয়।
১৭ বহু পিতামাতারা যেমন মনে করে থাকেন, যৌন বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া প্রকৃতই অত কঠিন হওয়া উচিৎ নয়। খুব শীঘ্রই বাচ্চারা তাদের দেহ সম্বন্ধে সজাগ হয়ে যায়, তারা বিভিন্ন অঙ্গগুলি আবিষ্কার করতে থাকে। আপনি বাচ্চার জন্য নামগুলি বলে দিন: হাত, পা, নাক, পেট, নিতম্ব, পুরুষাঙ্গ, স্ত্রীঅঙ্গ। আপনি যদি হঠাৎ জননেন্দ্রিয় সম্পর্কে “গোপন-গোপন” ভাব না করেন তাহলে ছোট বাচ্চাটি লজ্জিত হয় না। যেটি পিতামাতাকে একটু আতঙ্কিত করে তা হল তারা মনে করেন যে বাচ্চারা একবার প্রশ্ন করতে শুরু করলে, তাদের সবকিছু বর্ণনা করতে হবে। আসলে, সন্তান যেমন বড় হয় ও বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছায়, সেই সঙ্গে প্রশ্নও টুকরো-টুকরো করে আসে। বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছালে, আপনার দরকার প্রয়োজনীয় উপযুক্ত শব্দগুলি বলা এবং খুব সরল ও সাধারণ বিবরণ দেওয়া।
১৮ উদাহরণস্বরূপ, আপনাকে হয়ত একদিন জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘বাচ্চারা কোথা থেকে আসে?’ আপনি এরূপে বলে খুব সাধারণভাবে উত্তর দিতে পারেন: ‘তারা তাদের মায়ের ভিতরে বড় হয়।’ সাধারণত, তখনকার মত সেইটুকুই প্রয়োজন। পরে হয়ত সন্তান জিজ্ঞাসা করতে পারে, ‘বাচ্চা কিভাবে বাইরে আসে?’ ‘তার জন্য এক বিশেষ রন্ধ্র আছে।’ সে তখনকার মত তাতেই সন্তুষ্ট হয়।
১৯ কিছু দিন পরে হয়ত এইরকম প্রশ্ন আসতে পারে, ‘বাচ্চা কিভাবে শুরু হয়?’ আপনার উত্তর হয়ত এরূপ হতে পারে: ‘বাবা আর মা একটি বাচ্চা চান। বাবার কাছ থেকে বীজ মায়ের ডিম্বাণুতে এসে মিলে
যায় আর তখনই বাচ্চা বড় হতে আরম্ভ করে, ঠিক যেমন কোন বীজ মাটির মধ্যে বড় হয়ে ফুল বা গাছে পরিণত হয়।’ সুতরাং, এটি যেন একটি ক্রমশঃ গল্পের মত, বাচ্চাকে সন্তুষ্ট করার জন্য সময়মত প্রত্যেকটি অংশ যথেষ্ট হয়। পরে হয়ত বাচ্চা জিজ্ঞাসা করতে পারে, ‘বাবার বীজ কিভাবে মায়ের মধ্যে গেল?’ আপনি সরলভাবে বলতে পারেন: ‘তুমি জান যে ছেলে কেমন হয়। তার একটি পুরুষাঙ্গ থাকে। এরই যথাযথ মেয়েদের দেহে একটি রন্ধ্র থাকে। বীজ রোপন করা হয়। মানুষকে সেইভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে শিশু মায়ের মধ্যে শুরু হতে ও বড় হয়ে উঠতে পারে ও অবশেষে শিশু হয়ে বার হয়ে আসতে পারে’।২০ মিথ্যা গল্প বা “গোপন-গোপন” ভাব হিসাবে বিষয়বস্তুকে কোন এক অপছন্দের বিষয় হিসাবে উপস্থাপনা করার চাইতে এইরূপ সঠিক ব্যাখ্যা নিশ্চয় ভাল। (তুলনা করুন তীত ১:১৫.) আরও বাবামায়ের কাছ থেকেই বাচ্চার সঠিক ব্যাখ্যাটি শোনা ভাল, যারা তা বর্ণনা করতে গিয়ে কারণগুলি বলতে পারেন যে যারা বিবাহিত, পরস্পরকে ভালবাসে ও শিশুকে ভালবাসতে এবং যত্ন নিতে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদের কাছ থেকেই একমাত্র উপযুক্তরূপে শিশুরা আসতে পারে। ফলে বিষয়টিকে কোন এক অশ্লীল পটভূমিকায় শেখার পরিবর্তে এক গঠনমূলক ও আত্মিক স্তরে উপস্থাপনা করা হয়।
জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি প্রদান করা
২১ এক সময় যীশু তাঁর সময়কালের লোকেদের সম্বন্ধে বলেছিলেন “তাহারা এমন বালকদের তুল্য, যাহারা বাজারে বসিয়া আপনাদের সঙ্গিগণকে ডাকিয়া বলে, ‘আমরা তোমাদের নিকটে বাঁশী বাজাইলাম, তোমরা নাচিলে না; আমরা বিলাপ করিলাম, তোমরা বুক চাপড়াইলে না।’” (মথি ১১:১৬, ১৭) ছোট ছেলেমেয়েদের খেলা হল বড়দের অনুকরণ করা এবং তাদের উৎসব ও শোককেও অনুকরণ করা। যেহেতু শিশুর অনুকরণ করার স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে তাই বাবামায়ের উদাহরণ শিশুর শিক্ষায় এক শক্তিশালী ভূমিকা নেয়।
২২ জন্ম থেকেই আপনার সন্তান আপনার কাছ থেকে শিখছে—আপনি যা বলেন শুধুমাত্র তার দ্বারা নয় কিন্তু কিভাবে বলছেন তাও, কথা বলার সময় যে স্বর আপনি ব্যবহার করেন: শিশুর সাথে, আপনার সাথীর সাথে এবং অপরের সাথে। বাবামায়ের পরস্পরের সাথে আচরণ, পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রতি এবং অতিথিদের প্রতি আচরণ, শিশু লক্ষ্য করে। শিশুর হাঁটতে বা গুণতে অথবা কখগ পড়তে শেখার থেকেও এই সকল বিষয়ে আপনার উদাহরণ শিশুকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিতে আরম্ভ করে। এটি জ্ঞান ও উপলব্ধির এক ভিত্তি স্থাপন করতে পারে যা জীবন-যাপন করার সময় প্রকৃত সুখী হতে পরিচালিত করে। যখন শিশু কথা ও পড়ার মাধ্যমে শেখার জন্য যথেষ্ট বড় হবে তখন সেই উদাহরণ শিশুকে ধার্মিক মানের শিক্ষার প্রতি সাড়া দিতে পরিচালিত করবে।
২৩ “প্রিয় বৎসদের ন্যায় তোমরা ঈশ্বরের অনুকারী হও। আর প্রেমে চল,” এই বলে প্রেরিত খ্রীষ্টীয়দের উৎসাহ দেন। এটি বলার ঠিক আগে তিনি দেখান যে ঈশ্বরকে অনুকরণ করার অর্থ কী: “সর্ব্বপ্রকার কটুকাটব্য, রোষ, ক্রোধ, কলহ, নিন্দা এবং সর্ব্বপ্রকার হিংসেচ্ছা তোমাদের হইতে দূরীকৃত হউক। তোমরা পরস্পর মধুরস্বভাব ও করুণচিত্ত হও, পরস্পর ক্ষমা কর, যেমন ঈশ্বরও খ্রীষ্টে তোমাদিগকে ক্ষমা করিয়াছেন। অতএব প্রিয় বৎসদের ন্যায় তোমরা ঈশ্বরের অনুকারী হও . . . ” (ইফিষীয় ৪:৩১, ৩২; ৫:১, ২) শিশু যদি এমন স্বর শোনে বা আচরণ দেখে যা বিরক্তি প্রকাশ করে, যেমন জোরে ও তীক্ষ্ণভাবে কথা বলা, নাকী সুরে নালিশ করা, অযথা গর্ব করা বা অত্যন্ত ক্রোধ প্রকাশ করা, এই সবই মনে এক গভীর ছাপ ফেলে যা সহজে মোছা যায় না। যদি আপনি সকলের প্রতি দয়ালু হন ও বিবেচনা দেখান, যদি আপনার নৈতিক মান উচ্চ থাকে ও আপনার নীতিগুলি ভাল হয়, তাহলে আপনার সন্তান আপনাকে এই সকল ক্ষেত্রে অনুকরণ করবে। আপনার সন্তান যেভাবে আচরণ করবে বলে আপনি আশা করেন সেইভাবে আপনিও আচরণ করুন, আপনার সন্তানেরা যেরূপ হোক বলে আপনি আশা করেন আপনিও সেরূপ থাকুন।
২৪ পিতামাতাদের দুই প্রকৃতির নীতি থাকা উচিৎ নয়, একটি প্রচারের জন্য এবং অপরটি কাজে লাগানোর জন্য, একটি ছেলেমেয়েদের জন্য ও অপরটি নিজেদের জন্য। আপনি যদি নিজে মিথ্যা কথা বলেন, আর ছেলেমেয়েদের বলতে নিষেধ করেন তাহলে কী উপকার হবে? আপনি যদি তাদের কাছে আপনার প্রতিজ্ঞা না রাখেন তাহলে তারা আপনার কাছে প্রতিজ্ঞা রাখবে বলে কি আপনি আশা করতে পারেন? যদি পিতামাতারা পরস্পরের প্রতি সম্মানশীল না হন তাহলে তারা কিরূপে আশা করতে পারেন যে সন্তান সম্মান করা শিখবে? যদি সন্তান তার বাবা ও মাকে কখনও নম্রতা প্রদর্শন করতে না দেখে তাহলে নম্রতা কিরূপে তার মানে পরিণত হবে? পিতামাতারা সবসময় সঠিক কাজ করেন বলে শিশুকে ধারণা দিলে গুরুতর বিপদ আছে কারণ সন্তান মনে করবে যা কিছুই তিনি করেন তা সঠিক—এমন কি যখন তিনি কোন অসিদ্ধ, পাপজনক ও ভুল কাজও করেন। মুখে বলে তা কাজে না করা হল ভণ্ড ফরীশীদের মত করা যাদের সম্বন্ধে যীশু বলেছিলেন: “তাহারা তোমাদিগকে যাহা কিছু বলে, তাহা পালন করিও, মানিও, কিন্তু তাহাদের কর্ম্মের মত কর্ম্ম করিও না; কেননা তাহারা বলে, কিন্তু করে না।” তাই পিতামাতারা, আপনারা যদি ঘরে ছোট্ট ফরীশীদের না চান, তাহলে বড় ফরীশী হবেন না!—মথি ২৩:৩.
২৫ প্রথমে শিশুরা ভালবাসা দেখে শেখে এবং ভালবাসা পেয়ে তারা দিতেও শেখে। ভালবাসা কেনা যায় না। বাবামায়েরা ছেলেমেয়েকে প্রচুর উপহার দিতে পারেন। ভালবাসা মুখ্যত আত্মিক বিষয়, মানিব্যাগ থেকে নয় হৃদয় থেকে আসে, এবং উপহার কখনই আন্তরিক ভালবাসার বিকল্প হতে পারে না। ভালবাসাকে কেনবার চেষ্টা করলে তাকে সস্তা লূক ৬:৩৮) ঈশ্বরের প্রতি আমাদের প্রেম সম্বন্ধে ১ যোহন ৪:১৯ পদ যেমন বলে: “আমরা প্রেম করি, কারণ তিনিই প্রথমে আমাদিগকে প্রেম করিয়াছেন।”
করে দেয়। উপহার দেওয়ার চাইতেও, আপনি নিজেকে, আপনার সময়, শক্তি, ভালবাসা দিন। পরিবর্তে আপনি সেইরকমই পাবেন। (২৬ কোন কিছু গ্রহণ করার মাধ্যমে সন্তানেরা দিতে শেখে। কোন কিছু দেওয়াতে, ভাগ করে নেওয়াতে এবং সাহায্য করাতে যে আনন্দ আছে তা তাদের শেখাতে হবে। দেওয়ার মাঝে যে আনন্দ আছে তা তাদের দেখতে সাহায্য করুন—আপনাকে, অন্যান্য ছেলেমেয়েদের, বড়দের। অনেক সময় বড়রা ছোটদের কাছ থেকে উপহার নিতে চান না ভুল করে এই ভেবে, বাচ্চারা যা দিতে চাইছে তা না নেওয়া হল ভালবাসা দেখানো। এক ব্যক্তি বলেন:
“বাচ্চাটি যখনই আমাকে তার থেকে লজেণ্স দিতে চাইত আমি নিতাম না। সে যা সবচেয়ে ভালবাসে তা না নিয়ে, ভালবাসা দেখানো হবে বলে আমি মনে করতাম। আমি লজেণ্সটি না নিয়ে তাকে খেতে বললে, আমি বাচ্চার কাছ থেকে সেই আনন্দ দেখতে পেতাম না যা দেখাবে বলে আমি আশা করতাম। তারপর আমি বুঝতে পারি যে আমি তার উদারতাকে, তার উপহারকে এবং তাকে প্রত্যাখ্যান করছি। এরপর থেকে আমি সবসময় সেই প্রকৃতির উপহারগুলি নিয়ে থাকি, যাতে সে দেওয়ার আনন্দ বুঝতে পারে।”
২৭ এক পরিবারে, বাবামা চান যে তাদের ছোট্ট ছেলেটি বাইবেলের ১ তীমথিয় ৬:১৮ পদে বর্ণিত ব্যক্তিদের মত হোক যারা ‘দানশীল ছিল, সহভাগীকরণে তৎপর ছিল।’ তাই বাইবেল অধ্যয়ন করতে গেলে তারা যে টাকাটা দান হিসাবে দিতে চাইতেন সেটি তাদের ছেলেকে দিতেন যাতে সে দানের বাক্সে ফেলতে পারে। এটি তাকে আত্মিক বিষয়কে সমর্থন করার এবং এর জন্য হয়ত যা কিছু বস্তু সাহায্যের প্রয়োজন তা দেওয়ার মূল্যটি বুঝতে সাহায্য করে।
২৮ উত্তম উদাহরণের মাধ্যমে সঠিক নির্দেশ দিয়ে যদি ছেলেমেয়েরা ভালবাসা ও উদারতা শিখতে পারে তাহলে তারা উপযুক্ত ক্ষেত্রে ক্ষমাও
চাইতে শিখতে পারে। এক পিতা বলেন: “যখন আমি ছেলেমেয়ের কাছে ভুল করি, আমি তা প্রকাশ করি। সংক্ষেপে আমি তাদের বলি যে কেন আমি ভুল করেছি এবং আমারই ভুল হয়েছে। তাতে তাদের আমার কাছে ভুল স্বীকার করা সহজ হয়ে যায় কারণ তারা জানে যে আমিও সিদ্ধ নই এবং বিষয়টি বুঝতে পারব।” এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে একটি ঘটনার দ্বারা যেখানে একজন অপরিচিত ব্যক্তি একটি পরিবারের সাথে দেখা করতে আসেন ও পিতা পরিবারের সদস্যদের তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। পরিদর্শক মন্তব্য করেন:“উপস্থিত সকলকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর, হাসিখুশি একটি ছোট ছেলে ঘরের মধ্যে আসে। বাবা বলেন, ‘শার্টে জ্যাম লাগা এই ছেলেটি হল আমাদের সবচেয়ে ছোট ছেলে।’ ছেলেটির মুখ থেকে হাসি চলে যায় ও দুঃখের ভাব নেমে আসে। লজ্জিত হয়ে প্রায় সে কেঁদেই ফেলছিল, তা দেখে বাবা তাড়াতাড়ি তাকে কাছে টেনে নেন এবং বলেন, ‘আমার এটা বলা উচিৎ হয়নি; আমি দুঃখিত।’ ছেলেটি একটুক্ষণের জন্য কাঁদে ও তারপর ঘর থেকে চলে যায় কিন্তু শীঘ্রই একগাল হাসি নিয়ে ফিরে আসে—এখন সে অন্য একটি পরিষ্কার শার্ট পরেছিল।”
২৯ এই প্রকার নম্রতার জন্য প্রকৃতই স্নেহের বন্ধন দৃঢ় হয়। নিশ্চয়, পরে বাবামায়ের একজন সন্তানকে বলতে পারেন যে জীবনের বড় ও ছোট সমস্যাগুলির প্রতি কিভাবে ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রাখা যেতে পারে। বাবা তার ছেলেমেয়েদের শেখাতে পারেন যে তারা যেন ছোট ছোট বিষয়কে বেশি গুরুতরভাবে না দেখে, নিজের ভুলে নিজেই হাসতে শেখে এবং অপরের কাছ থেকে কখনও সিদ্ধতা আশা না করে যেমন তারা মনে করে অপরেরাও তাদের কাছ থেকে আশা না করুক।
নির্দিষ্ট প্রকৃত মূল্যগুলি প্রদান করুন
৩০ জীবনের প্রকৃত মূল্যগুলি কী, সেই সম্পর্কে বহু পিতামাতারা বর্তমানে বিভ্রান্ত। ফলে, অনেক ছেলেমেয়েদের নির্দিষ্ট মূল্যগুলি প্রদান করা হয় না। এমন কি কিছু পিতামাতারা ছেলেমেয়েদের আচরণ sexual revolution)—এই সমস্ত পিতামাতাদের আতঙ্কিত করে। কিন্তু প্রকৃত বিষয়টি হল জীবনে এই সকল প্রশ্ন ওঠার আগেই সন্তানের ব্যক্তিত্ব ইতিমধ্যেই অনেকটা গঠন হয়ে যায়।
সংশোধন করার তাদের অধিকার সম্বন্ধে সংশয় বোধ করেন। যদি পিতামাতারা না করেন, তাহলে সেই কাজটি অন্যান্য ছেলেমেয়েরা, প্রতিবাসী, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন করবে। বংশের ব্যবধান, যুবক-যুবতীদের বিদ্রোহ, নেশাকর ওষুধ, নব নৈতিকতা এবং যৌন বিপ্লব (৩১ এক বৈজ্ঞানিক পত্রিকাতে লিখিত এক গবেষণা জানায় যে “স্কুলে যাওয়ার আগেই ব্যক্তিত্বের বেশির ভাগ অংশ গঠন হয়ে যায়। এটি সকলের অবগত যে, স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি এমন ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত প্রভাবিত হতে পারে ও নমনীয় হয়। . . . কিন্তু, আমরা এই আবিষ্কার করেছি যে, আচরণ ও অভিজ্ঞতা হিসাবে তারা ছেলেবেলায় যে সব জিনিসের সম্মুখীন হয়েছে তা তাদের উপর বেশির ভাগ সময় স্থায়ী এবং কিছু সময় অপরিবর্তনীয় আচরণ স্থাপন করে থাকে।”
৩২ ভুল প্রকৃতির আচরণকে পরিবর্তন করা যায় কিন্তু যদি মূল্যবান বছরগুলিকে এমনি যেতে দেওয়া হয়, তাহলে কী হয় তা অপর এক গবেষক বলেন: “সন্তান তার প্রথম সাত বছর নমনীয় থাকে, কিন্তু যদি আপনি বেশি অপেক্ষা করেন, তাহলে আপনাকে তার পরিবেশের মূলগত পরিবর্তন আনতে হবে—এবং পরিবর্তনের সম্ভাবনা প্রতি বছর কম হতে থাকে।”
৩৩ ছোট ছেলেমেয়েদের বহু মূল বিষয়গুলি শিখতে হয়, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হল কোন্টি সত্য ও কোন্টি মিথ্যা, কোন্টি সঠিক ও কোন্টি ভুল তার ধারণা করা। ইফিষীয়ের খ্রীষ্টীয়দের লেখার সময় প্রেরিত পৌল এই বলে তাদের সঠিক জ্ঞান নিতে উৎসাহ দেন: “যেন আমরা আর বালক না থাকি, মনুষ্যদের ঠকামিতে, ধূর্ত্ততায়, ভ্রান্তির চাতুরীক্রমে তরঙ্গাহত এবং যে সে শিক্ষাবায়ুতে ইতস্ততঃ পরিচালিত না হই; কিন্তু প্রেমে সত্যনিষ্ঠ হইয়া সর্ব্ববিষয়ে তাঁহার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধি পাই, যিনি মস্তক, তিনি খ্রীষ্ট।” (ইফিষীয় ৪:১৩-১৫) ছোটদের সত্য ও সততা, সঠিক ও উত্তম এগুলির প্রতি ভালবাসা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে যদি বাবামারা দেরি করেন তাহলে ছেলেমেয়েরা ভুল ও অন্যায়ের প্রতিরোধহীন হয়ে পড়বে। পিতামাতারা প্রায় উপলব্ধি করার আগেই ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার আগের বয়সকাল পেরিয়ে যায়; সেগুলিকে এমনি চলে যেতে দেবেন না; ছেলেমেয়েদের নির্দিষ্ট প্রকৃত মূল্যগুলি দিতে সেই প্রথম কয়েকটি, গুরুত্বপূর্ণ, গঠনমূলক বছরগুলি তাদের সাথে ব্যয় করুন। তাহলে হয়ত আপনি পরবর্তীকালের দুঃখ থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন।—হিতোপদেশ ২৯:১৫, ১৭.
৩৪ “এই জগতের দৃশ্যপট পরিবর্তিত হইতেছে,” লেখেন অনুপ্রাণিত প্রেরিত এবং বস্তুগত, মানসিক ও নৈতিক মানের ক্ষেত্রে এটি প্রকৃতই সত্য। (১ করিন্থীয় ৭:৩১, NW) জগতে খুব কমই স্থিরতা আছে। পিতামাতাদের উপলব্ধি করা দরকার যে মানুষ হওয়ার জন্য, তারাও এই ক্ষেত্রে ভুল করতে পারে। যদি তারা আন্তরিকভাবে ছেলেমেয়েদের মঙ্গল কামনা করেন এবং তাদের ভবিষ্যতের সুখের জন্য চিন্তিত হন তাহলে পিতামাতারা ছেলেমেয়েদের নির্দিষ্ট মানের প্রতি পরিচালিত করবেন যা প্রকৃতই স্থায়ী। যে কোন প্রশ্ন আসুক, যে কোন সমস্যার সমাধানের প্রয়োজন হোক না কেন ঈশ্বরের লিখিত বাক্য, বাইবেলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা উচিৎ কারণ তা হল নিত্তিমূলক ও সবচেয়ে সাহায্যকারী, এই বিষয়টি পিতামাতারা শিশুকাল থেকে ছেলেমেয়েদের মনে গেঁথে দিয়ে তা করতে পারেন। জীবনের পরিস্থিতিগুলিকে যতই বিভ্রান্তিকর ও অন্ধকারময় বলে মনে হোক না কেন, সেই বাক্য ক্রমাগত ‘তাদের চরণের প্রদীপ, তাদের পথের আলোক’ থাকবে।—গীতসংহিতা ১১৯:১০৫.
৩৫ হ্যাঁ, আপনার ছেলেমেয়েদের নির্দিষ্ট মূল্য দিয়ে গঠন করার এটিই হল সুবর্ণ সুযোগের সময় যা তাদের চিরকাল সাহায্য করবে। আপনার ছেলেমেয়েকে শিক্ষা দেওয়ার চাইতে কোন বৃত্তিই মহত্তর নয়, কোন কাজই অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়। জন্মাবার সাথে সাথে, শিশুকাল থেকেই শুরু করার সময়!
[অধ্যয়ন প্রশ্নাবলি]
১-৪. ছোট বাচ্চার প্রচণ্ড শেখার ক্ষমতা আছে তার কী প্রমাণ আছে?
৫. সন্তানের শিক্ষা কত শীঘ্র শুরু করা দরকার?
৬. (ক) শিশুর সাথে কী ধরনের ভাষায় কথা বলা সবচেয়ে ভাল? (খ) সন্তান যে সব প্রশ্নগুলি করে তার প্রতি কী প্রকারের দৃষ্টিভঙ্গি রাখা উচিৎ?
৭. ছোট শিশুর প্রশ্নগুলি কিভাবে উত্তমরূপে উত্তর দেওয়া যেতে পারে এবং কেন?
৮, ৯. সন্তানকে ধীরে ধীরে পড়তে শেখাতে কী করা যেতে পারে?
১০. প্রত্যেক সন্তানকে তার ক্ষমতার বিকাশ করতে দিতে সাহায্য করা কেন বিজ্ঞতার কাজ হবে?
১১. একটি সন্তানের প্রতিকূলে অপর সন্তানের সাথে তার তুলনা করা কেন বিচক্ষণতার কাজ নয়?
১২. বড়দের সম্পর্কে কোন্ বিষয়গুলি প্রদর্শন করে যে সন্তানের সঠিক পরিচালনার প্রয়োজন?
১৩, ১৪. দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৬, ৭ পদের পরামর্শ অনুসারে পিতামাতারা কিভাবে ছেলেমেয়েদের নির্দেশ দিতে পারেন?
১৫. সন্তানকে তার প্রচেষ্টাগুলিতে উন্নতি করতে কিভাবে উৎসাহ দেওয়া যায়?
১৬. বাইবেল যা বলে তা মনে রেখে, যৌন বিষয় সম্পর্কে সন্তানের প্রশ্নের কিরূপ উত্তর দেওয়া উচিৎ?
১৭-১৯. যৌন বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা কিভাবে ক্রমশঃ দেওয়া যেতে পারে?
২০. কেন পিতামাতার পক্ষেই সন্তানকে যৌন বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া ভাল?
২১. ছেলেমেয়েদের কোন্ প্রবণতার জন্যই পিতামাতাদের সন্তানদের জন্য উত্তম উদাহরণ স্থাপন করা গুরুত্বপূর্ণ?
২২. পিতামাতার আচরণ ছেলেমেয়েদের উপর কী প্রভাব আনতে পারে?
২৩, ২৪. পিতামাতারা যদি সন্তানদের কাছ থেকে বিশেষ মান আশা করেন তাহলে তাদের নিজেদের কী করা দরকার?
২৫. ভালবাসা সম্পর্কে সন্তানদের কিভাবে শেখানো যায়?
২৬, ২৭. দেওয়ার মাধ্যমে যে আনন্দ আসে সেই সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের কিভাবে শেখানো যেতে পারে?
২৮, ২৯. ভুল করলে ক্ষমা চাওয়ার গুরুত্ব সন্তানদের কিভাবে শিখানো যেতে পারে?
৩০-৩২. পিতামাতাদের ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকে জীবনের প্রকৃত মূল্যগুলিকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
৩৩. গুরুত্বপূর্ণ কোন্ ধারণাগুলি সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেওয়া দরকার?
৩৪. স্থায়ী মান কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই প্রকৃতির মানের সবচেয়ে উত্তম উৎস কোন্টি?
৩৫. সন্তানকে শিক্ষা দেওয়া কত গুরুত্বপূর্ণ?
[১১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
শিক্ষাকে এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা করুন